ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। কীটতত্ত্ববিদরা রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। তাঁরা বলেছেন, সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মশা মারতে যেসব কার্যক্রম চালাচ্ছে এতে মশা মরছে না। এসব উদ্যোগ অনেকটাই লোক দেখানো। মশা নিধনের নামে চলছে তামাশা। এসব উদ্যোগের বাস্তব কোনো কার্যকারিতা ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। নীতিনির্ধারকরা অবৈজ্ঞানিক পন্থায় হাঁটছেন। এতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মারা যাচ্ছে মানুষ। কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী ‘কেন এই ডেঙ্গু মহামারি? পরিত্রাণ কোন পথে’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে বলেন, মশা নিধনের নামে তামাশা চলছে। ব্যাঙ, হরিণ আর হাঁস দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। পৃথিবীর আর কোথাও এমনটা দেখা যায় না। ডোবা–নালায় এডিস মশা ডিম পাড়ে সেটারও কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মশা মারার জন্য ফগার মেশিনও কাজ করে না বলে অভিযোগ করেন তিনি। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে ফুলহাতা শার্ট, হাতে পায়ে মোজা, দিনে মশারির ভেতর ঘুমানো এবং অফিসে প্রতিদিন সকালে অ্যারোসেল ব্যবহারের পরামর্শ দেন এই কীটতত্ত্ববিদ। পাশাপাশি যে এলাকায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাবে সেখানে ক্রাশ কর্মসূচি চালানোর কথা বলেন তিনি।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ফ্যাকাল্টি ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত তা করা হয় না। মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ও প্রকৃত জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। যে ফগিং করা হয় তাতে কিন্তু মশা মরে না। এডিস মশার জন্য যেসব কীটনাশক প্রয়োজন তা নেই আমাদের। গবেষণায় গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আমাদের এমনকিছু লোক থাকতে হবে, যারা সব সময় এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করবে। কারণ মশা প্রতিনিয়ত তার ধরন পালটাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। কিন্তু জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই। কীটতত্ত্ববিদরা মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার কথা বলেন। এজন্য প্রথমত, চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। কেননা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মশা বেশি জন্মায়। দ্বিতীয়ত, জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে কোথায় কোথায় মশা বেশি, কোন ধরনের মশার উপদ্রব বেশি এবং এ মশার জন্য কোন ওষুধ কতটুকু ছিটাতে হবে, তা নির্ণয় করে ওই জায়গায় ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। যেন এসব জায়গায় নতুন করে মশা জন্মাতে না পারে। এছাড়া মশার অতিরিক্ত প্রজনন বন্ধের জন্য জলাশয়ে মাছ, হাঁস ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, রাসায়নিক ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সবশেষ সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ চারটিকে একত্রে কীটতত্ত্ববিদদের মতে ‘সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা’ বলা হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে ডেঙ্গুর পাশাপাশি ম্যালেরিয়া রোগের প্রভাব রয়েছে। বিশ্বব্যাপী মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হলো ম্যালেরিয়া। অ্যানোফিলিস মশার সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। এর মধ্যে চারটি প্রজাতিকে প্রধান বাহক বলা হয়। পার্বত্য জেলা এবং সীমান্তবর্তী এলাকার ১৩ জেলায় ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। তবে ওষুধ খেলেই ম্যালেরিয়া সেরে যায়। সরকার ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় ঢাকা শহরে বসবাসরতদের ঝুঁকি বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ডেঙ্গুতে রাজধানীর সব বাসিন্দা আক্রান্ত হতে পারেন। এজন্য ডেঙ্গু প্রতিরোধে যে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন সেক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে নাগরিকদের সচেতনতাও প্রত্যাশা করেন তাঁরা। তাই, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে চলবে না, কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।