দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে চট্টগ্রামে গত কয়েক বছর ধরে কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। কোনোভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা যাচ্ছে না। দুর্দমনীয় হয়ে ওঠা এসব গ্যাং নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত ১৯ মে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, নগরীতে আবারও কিশোর গ্যাং নেতার টর্চার সেলের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। ওখানে এক কিশোরকে টানা ১০ ঘণ্টা আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। কেড়ে নেওয়া হয় তার কাছে থাকা চারটি মোবাইল। দাবি করা হয় এক লাখ টাকা। রাতভর অভিযান চালিয়ে পুলিশ ওই কিশোরকে উদ্ধারের পাশাপাশি গ্রেপ্তার করে কথিত ছাত্রলীগ নেতা হেলাল বাদশা চৌধুরী (২৫) ও তার সাত সহযোগীকে। গ্রেপ্তার বাকি সদস্যরা হলো রাকিব হোসেন (২২), মো. কাউসার (২২), মেহেরাজ সামি (২১), শেখ সাদি হাসান (২০), সাগর হোসেন (২৭), আবদুর রহমান (২১) ও সাইফুল ইসলাম শান্ত (২৬)। এদের মধ্যে রাকিব হোসেন নিজেকে ওমরগণি এমইএস কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র বলে পরিচয় দিয়েছে। রাকিব ছাড়া বাকিদের কেউ পড়ালেখা করে না। তবে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়। মূলত এ পরিচয়েই তারা জিইসি মোড়সহ আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
অভিযানে ছিনিয়ে নেওয়া চারটি মোবাইল সেট, ঘটনায় ব্যবহৃত কিরিচ, লোহার পাইপ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া হেলাল বাদশার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাটা গলিতে অভিযান চালিয়ে একটি এলজি ও দুটি কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার আটজনের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করেছেন। এর আগে গত মাসে নগরীর আকবরশাহ থানার পশ্চিম ফিরোজ শাহ এলাকায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বাধীন কিশোর গ্যাংয়ের টর্চার সেলের খোঁজ পেয়েছিল পুলিশ।
আজাদীতে ইতোপূর্বে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক নেতাদের মদদে দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। পাড়া–মহল্লায় গড়ে ওঠা এসব গ্রুপের দৌরাত্ম্য রুখতে তালিকা হচ্ছে মদদদাতাদের। গত কয়েক বছর ধরে কিশোর অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সিনিয়র–জুনিয়র দ্বন্দ্ব, সিগারেট খাওয়া, প্রভাব বিস্তারের জেরে হরহামেশা ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়া, মারধর, সশস্ত্র হামলা, এমনকি খুন করতেও দ্বিধা করছে না তারা। গত এক বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত এক ডজন খুনের ঘটনা ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোরদের বয়স বিবেচনায় আইনের সীমাবদ্ধতা এ ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে রয়েছে। আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর না হলে ছেলে–মেয়েদের কিশোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যারা জড়িয়ে রয়েছে তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। ফলে গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোর অপরাধীদের গ্রেফতার করা হলেও সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া জোরালো আইনি পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
বলা বাহুল্য যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাং এখন ‘বিষফোঁড়ায়’ পরিণত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, যে কিশোর–তরুণ দেশের ভবিষ্যৎ, দল বেঁধে তাদের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা উৎকণ্ঠার বিষয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মই যদি উচ্ছনে কিংবা গোল্লায় যায়, তাহলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছু থাকে না। বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে এক–দুজনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমই যথেষ্ট। এ বিবেচনায়, কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত অসংখ্য বিপথগামী কিশোরের উৎপাত সংশ্লিষ্ট এলাকার শান্তি–শৃঙ্খলা বিনষ্ট ও ত্রাস সৃষ্টি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। কিশোর গ্যাং যদি এখনই প্রতিহত ও নির্মূল করা না যায়, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবার ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর উদ্যোগ ছাড়া ‘গ্যাং কালচার’ রোধ সম্ভব হবে না, এক্ষেত্রে প্রথমেই বাবা–মাকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানরা কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, এ ক’টি বিষয়ে পর্যাপ্ত মনিটারিং করতে পারলেই গ্যাংয়ের মতো বাজে কালচারে সন্তানের জড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব!