কিশোরকবিতার রঙিন জগতে

আনিসুর রহমান | বুধবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৪৯ পূর্বাহ্ণ

আমার জানা মতে প্রাচ্যে সঙ্কলনের চল জাপানে শুরু হয়েছিল নবম শতকেই, পাঁচ লাইনের ৩১ মাত্রার কাব্যনিদর্শন ওয়াকা‘ (waka) বা ‘টাকা’ (Tanka) কবিতার সঙ্কলন প্রকাশের মাধ্যমে। পাশ্চাত্যে শুরু হয়েছিল এই চল দশম শতকে। পাশ্চাত্যে সঙ্কলনের এই উদাহরণ দশম শতকের বাইজান্টাইন নিদর্শন যা ‘দ্য প্যালাটাইন’ এন্থোলজি (The Palatine Anthology) নামে পরিচিত। এটি জার্মানির হাইডেলবার্গ গ্রন্থাগারে ষোড়শ শতকে আবিষ্কৃত হয়। আমাদের বঙ্গমুল্লুকে কিংবা ভারতবর্ষে সঙ্কলনের নির্দিষ্ট সময়ক্রম আমার জানা নাই।

শুরুর দিকে নানা দেশে ধর্মীয় ধ্যানধারণা নির্ভর কথামালা বা লেখাজোখা এক সঙ্গে প্রকাশের উদ্যোগ হিসেবে সঙ্কলন প্রকাশিত হত। পরের দিকে শিক্ষাকার্যক্রমের অংশ হিসেবে পাঠ্যপুস্তকের আদলে সঙ্কলন প্রকাশিত হয়ে আসছে। এরকম নিদর্শন একেবারে পাঠশালা পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চালু আছে দেশে দেশে। এর পাশাপাশি লেখালেখির জন্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ বা পৃষ্ঠপোষকতা চালু হবার ফলে দুনিয়ার নানা প্রান্তের একাডেমি ও প্রতিষ্ঠান হরেক রকমের সঙ্কলন প্রকাশ করে থাকে। এরকম উদাহরণ আমাদের বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি যেমন, তেমনি ভারতের সাহিত্য একাডেমি, কাঠমাণ্ডুর নেপাল একাডেমি, পাশ্চাত্যের সুইডিশ একাডেমি, গ্যেটে ইনস্টিটিউট, ফরাসি একাডেমিসহ নানা প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা যায়।

এক পর্যায়ে নানা দেশের বাণিজ্যিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনা সংস্থাও বিবিধ তত্ত্ব লেখালেখির বাহারি ধ্যানধারণার মোড়কে রকমারি সঙ্কলন প্রকাশ করতে থাকে। এই চল আমাদের দেশেও বিদ্যমান। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তত্ত্বাবধানে সাহিত্যের নানা শাখায় বিশেষ করে কবিতা গল্প এবং প্রবন্ধের তাৎপর্যপূর্ণ সঙ্কলন প্রকাশিত হত। সেই চল এখন আর বলবৎ আছে কি না, এমন কোনো হদিস আমার কাছে নাই। শিশুসাহিত্য কিংবা কিশোরদের জন্যে বরাবর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক পণ্ডিত বুজুর্গ মান্যজনদের মনোযোগের বাইরেই অনেকটা থাকে।

সম্পাদক সুজন বড়ুয়ার প্রাককথন থেকে বলা যায় বাংলা ভাষার ভুবনে আধুনিক কিশোরকবিতাকে বড়দের অন্যবিধ কবিতা থেকে আলাদা করে আধুনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রগণ্য রবীন্দ্রনাথ। তিনি ছোটদের জন্যে রচিত কবিতাগুলোকে বড়োদের কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন নি। এখানে শিশু (১৯০৩) এবং শিশু ভোলানাথ‘ (১৯২২) গ্রন্থ দুটির কথা উল্লেখ করা যায়।

বাংলা ভাষার জগতে শিশুসাহিত্য নিয়ে কিংবা কিশোরকবিতার সঙ্কলন নানা উদাহরণ আমাদের সামনে আছে বটে। তবে এসব গ্রন্থমালায় আধুনিক কিশোরকবিতার হালহকিকত অনুপস্থিত।

এহেন বাস্তবতায় কিশোরদের জন্যে মানানসই লেখালেখি বা কিশোরকবিতা নিয়ে সমৃদ্ধ এবং সর্বজনগ্রাহ্য কোনো বাংলা ভাষার জগতের বাংলাদেশ, পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরাসহ ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যে বাংলাভাষাভাষী এবং ভারতবর্ষের বাইরে বসবাসকারী বাঙালি লেখকদের কিশোরকবিতা নিয়ে কোনো সঙ্কলনের উদাহরণ আমাদের সামনে নতুন এক সংযোজনের প্রয়োজন ছিল। সুজন বড়ুয়া এবং অরুণ শীল সম্পাদিত ‘রঙিন দিগন্ত’ নামের আধুনিক কিশোর কবিতার এই সঙ্কলন প্রকাশের মাধ্যমে সেই প্রয়োজন মিটিল। আমাদের ঢাকা আজ বাংলা ভাষা সাহিত্যের রাজধানী। এই অভিধায় প্রকাশনাটি নতুন মাত্রা যোগ করবে।

অভিনব এই প্রকাশনার প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ এবং প্রকাশ করেছেন মোশতাক রায়হান ঢাকার আদিগন্ত প্রকাশনা সংস্থা থেকে, কোনো রকম বাণিজ্যিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই।

তিন শত চব্বিশ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয়া মাইকেল মধুসূদনের কিশোরকবিতা থেকে শুরু করে ১৯৯৮ সালে জন্মগ্রহণকারী লিয়ন আজাদের কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে এই গ্রন্থে বাংলা ভাষাভাষী দুনিয়ার শ তিনেকের মত কবির কিশোরকবিতা স্থান পেয়েছে। দুই একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি এই সঙ্কলনের বাইরে রয়ে গেছেন, হয় তো তাদের কিশোরদের উপযোগী কোনো কবিতা না থাকার কারণে।

এই গ্রন্থটি অনেকগুলো কারণে আমাদের সময়ের উপরে ভবিষ্যতের জন্যে একটি স্থায়ী ছাপ রেখে যাবে। সঙ্কলনের জন্যে নাম ধরে ধরে লেখা সংগ্রহের পরিবর্তে তারা কিশোরকবিতার প্রমত্ত পদ্মায় ইলিশ ধরার মত দক্ষ জেলের ভূমিকা পালন করেছেন। কোনোরকম রাষ্ট্রাচার, প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাত, গোষ্ঠীতোষণ কিংবা কাউকে খুশি বা বিব্রত করার অভিপ্রায় থেকে শতভাগ মুক্ত থেকে কেবল পাঠরুচির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে কবিতাগুলো প্রকাশনার এই জালে তুলে এনেছেন।

কবিতাগুলো পড়ার মাঝে একটা উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা কাজ করে। একই সঙ্গে কবিদের পরিচিতির একটা অভাব অনুভূত হয়েছে কখনো কখনো।

এই পর্যায়ে গ্রন্থভুক্ত মধুসূদনের বঙ্গভাষা কবিতার শেষের দুটি লাইন তুলে ধরতে চাই:

পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে

মাতৃভাষারূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে !

এই গ্রন্থটি জগতের অন্যবিধ আধুনিক ভাষায় অনূদিত হলে বিশ্বসাহিত্যে কিশোরকবিতার ইতিহাসে এটি একটি অগ্রগণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। গ্রন্থটি এই সময়ের এবং ভবিষ্যতের সকল বয়সের পাঠকের জন্যে রুচি ও আগ্রহের অনুকূলে একটি সংযোজন হতে পারে। এমন কি ভবিষ্যতের লেখক ও গবেষকদের জন্যে এই গ্রন্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে কাজে দিবে। গ্রহণযোগ্যতার বিচারে এই সংক্রান্ত অন্যবিধ প্রকাশনাগুলোকে ছাপিয়ে যাবে, এমন দৃশ্য কল্পনা করতে পারি।

গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো চিরকালীন বিষয়অনুষঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে করোনা মহামারী, রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ, গাজার উপর ইসরাইলের আগ্রাসনসহ দেশে দেশে সমসাময়িক নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে রচিত, যা কিশোর মনের উপযোগী। কিশোরকবিতার জগৎ আদতে একটি কিশোর মনের যাপিত কল্পিত স্বাধীন সার্বভৌম ভিন্ন এক জগৎ। কলমের আগায় এই জগতের নাগাল পাওয়া বড়ই কঠিন। আমাদের বাংলা কবিতার অনেক কিংবদন্তি প্রতিভাসহ বহুবিধ কবিই এই জগতের নাগাল পেয়েছেন। আমাদের বাংলা সাহিত্যের এই জগৎ বড় রঙিন, দৃষ্টিনন্দন এবং শ্রুতিমধুর। সেই সঙ্গে বুদ্ধিবুদ্ধির তীক্ষ্ণচঞ্চল নাটকীয় আবহও উল্লেখ্য। সম্পাদকদ্বয় লেখালেখির দীর্ঘ যাত্রায় তাদের অভিজ্ঞতা ও চেষ্টার নির্যাস ঢেলে অনেকটা খেয়ালি দৃষ্টি পঠন ও অভিজ্ঞতার আলোকে লেখাগুলো এক জায়গায় করেছেন।

প্রমত্ত পদ্মার বুকে পূর্ণিমার রাতটা রুপালি রঙিন ইলিশ জলের নীলশুভ্র টলমল ঢেউ আর শব্দের খেলার সঙ্গে চাঁদের আলো মিলেয়ে আলো রঙের খেলা আর মনের দোলার সমাবেশ হয়, আধুনিক কিশোরকবিতার রঙিন দিগন্তগ্রন্থ সেই রকমই বটে। এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ কবিতা থেকে দুটি লাইন উদ্ধৃত করতে চাই: ‘পাতাল ফেড়ে নামবো নিচে, উঠবো আমি আকাশ ফুঁড়ে/ বিশ্বজগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।

একটি কিশোর মনের জগৎ তো এমনই। আধুনিক কিশোরকবিতার ডালা ‘রঙিন দিগন্ত’ গ্রন্থটিও ঠিক তাই।

লেখক: বাঙালিসুইডিশ কবি ও নাট্যকার, সুইডিশ রাইটার্স ইউনিয়নের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবন ও বাস্তবতা
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে