চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেনার এবং জাহাজজটের জন্য কাস্টমসের শুল্কায়নে শ্লথ গতিকে দায়ী করছেন আমদানিকারকরা। বন্দর কর্তৃপক্ষ জরুরি চিঠি দিয়ে আমদানিকারকদের কন্টেনার খালাস করার তাগাদা দিলেও শুল্কায়নের শ্লথ গতির কারণে কন্টেনার ডেলিভারিতে গতি ফিরছে না বলে জানিয়েছেন তারা। একাধিক আমদানিকারক বলেছেন, গত এক সপ্তাহ ধরে ঘুরেও পণ্য শুল্কায়ন করতে পারছেন না অনেক আমদানিকারক। কাস্টমসের কার্যক্রম চললেও পুরোদমে গতি আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ীরা।
অপরদিকে সিঅ্যান্ডএফ কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্যাংক থেকে নগদ টাকা ওঠানোর সীমা বেঁধে দেওয়ায় সমস্যা প্রকট হয়েছে। নগদ টাকার লেনদেন কমে যাওয়ায় ঘাটে ঘাটে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে তারা জানান। শুল্কায়নে শ্লথ গতির পাশাপাশি বন্দরের অভ্যন্তরে গাড়ি চলাচলসহ কন্টেনারজটে ইকুইপমেন্ট মুভমেন্টে সমস্যা এতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গতকাল দুপুরের পর থেকে বন্দরমুখী গাড়ির জটলা পোর্ট কানেক্টিং রোড ধরে অলংকারে গিয়ে ঠেকে। সবকিছু মিলে দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য সংকটের মুখে। চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টমসে ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালিত না হলে এই সংকট ভোগাবে বলে ব্যবসায়ীরা মন্তব্য করেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেনারের জট কমেনি। বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ জাহাজও অলস বসে আছে। বন্দরের অভ্যন্তরে পুরোদমে কাজ চললেও ইয়ার্ডে কন্টেনার বাড়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বন্দর থেকে কন্টেনার ডেলিভারি, আইসিডি থেকে বন্দরে কন্টেনার আনা–নেওয়াসহ সার্বিক কার্যক্রম স্বাভাবিক মাত্রায় উন্নীত হয়নি। গতকাল দুপুরের পর বন্দরের অভ্যন্তরে গাড়ি প্রবেশ এবং বের হওয়াকে ঘিরে তীব্র জটলার সৃষ্টি হয়। বেসরকারি ১৯টি আইসিডি থেকে কন্টেনার প্রেরণ এবং বন্দরের ইয়ার্ড থেকে কন্টেনার আনার স্বাভাবিক কার্যক্রম এ সময় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বন্দরের যানজট চার কিলোমিটারের বেশি লম্বা হয়ে অলংকার মোড় পর্যন্ত চলে যায়। পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় না থাকায় যানজট তীব্র হয়। দুপুরের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী এবং স্থানীয় বাসিন্দা, দোকান কর্মচারী, এমনকি রিকশা চালকদেরও যানজট সামাল দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে দেখা যায়।
চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে গতকাল ৪৩ হাজার ৫৭৮ টিইইউএস কন্টেনার ছিল। ৩০/৩১ হাজার টিইইউএসের স্থলে এত বিপুল সংখ্যক কন্টেনার থাকায় বন্দরের অভ্যন্তরে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল। গতকাল বন্দর থেকে ৪ হাজার ৭৬০ টিইইউএস কন্টেনার ডেলিভারি হয়েছে। এর মধ্যে আমদানিকারকরা নিয়ে গেছেন ৪ হাজার ২৪৫ টিইইউএস এবং আইসিডিতে নেওয়া হয়েছে ৫১৫ টিইইউএস। গতকাল জাহাজ থেকে ইয়ার্ডে কন্টেনার নামানো হয়েছে ৪ হাজার ৩৩৮ টিইইউএস এবং জাহাজিকরণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৯৫৫ টিইইউএস। এর মধ্যে বন্দরের ইয়ার্ড থেকে জাহাজে তোলা হয়েছে ১ হাজার ৬ টিইইউএস এবং আইসিডি থেকে এনে জাহাজিকরণ করা হয়েছে ২ হাজার ৯৪৯ টিইইউএস। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুল্কায়নে গতিসহ বন্দরের অভ্যন্তরে গাড়ি চলাচল এবং ইকুইপমেন্ট মুভমেন্ট ঠিকভাবে চালানো গেলে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ আরো বেশি হতো।
ঢাকার শীর্ষ একজন আমদানিকারক গতকাল আজাদীকে বলেন, আমার জাহাজ থেকে কন্টেনার নেমেছে প্রায় দশ দিন আগে। গত এক সপ্তাহ ধরে আমার সিঅ্যান্ডএফ প্রতিদিন কাস্টমসে যাচ্ছে, অথচ শুল্কায়ন হচ্ছে না। ফলে কোনো কারণ ছাড়াই আমার কন্টেনার আটকা পড়ে আছে। আমাকে ডেমারেজ গুণতে হচ্ছে। কাস্টমসের কাজ শ্লথ হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলেও কেন যে এমনটি হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না।
চট্টগ্রামের একটি সিঅ্যান্ডএফ ফার্মের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, কাস্টমসে আমরা ব্যাংকের মাধ্যমে শুল্ক পরিশোধ করছি। কিন্তু কাজের গতির জন্য নগদ টাকার প্রয়োজন হয়। ব্যাংক থেকে দুই লাখ টাকার বেশি ওঠানো যাচ্ছে না। এতে করে নগদ টাকার ক্রাইসিসে পড়ে গেছি। ফলে কাজ আর আগের মতো হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার সাইদুল ইসলাম গত রাতে আজাদীকে জানান, কাস্টমসের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই চলছে। গতি শ্লথ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট এসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানি রিগ্যান বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টমসে আমদানি পণ্যের বিল অব এন্ট্রি দাখিল স্বাভাবিক আছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে যে পরিমাণ চালান এসেছে, সে অনুপাতে শুল্কায়ন কার্যক্রম হয়নি। মূলত অনেক আমদানিকারক দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। তাই শুল্কায়নের গতি কম।
বেসরকারি আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডার মহাসচিব মোহাম্মদ রুহুল আমীন সিকদার বলেন, চট্টগ্রামের ১৯টি আইসিডিতে কন্টেনারের পাহাড় গড়ে উঠেছে। সচরাচর আইসিডিগুলোতে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টিইইউএস পর্যন্ত রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার থাকে। গতকাল সেখানে ১৫ হাজার ৫৭৫ টিইইউএস কন্টেনার ছিল। আগের দিনের চেয়ে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। আইসিডি থেকে বন্দরে কন্টেনার প্রেরণের কার্যক্রমে স্থবিরতা আসায় আইসিডিগুলোতে কন্টেনারের পাহাড় গড়ে উঠছে।
এদিকে বহির্নোঙরে গতকাল ১৬টি কন্টেনার জাহাজ অলস বসেছিল। এর মধ্যে ৯টি জাহাজ গিয়ারলেস (যে জাহাজের নিজস্ব ক্রেন নেই। গ্যান্ট্রি ক্রেন ছাড়া কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে পারবে না।) এবং ৭টি গিয়ার ভ্যাসেল। এর মধ্যে ৭ আগস্ট বহির্নোঙরে পৌঁছেছে এমন জাহাজও রয়েছে। একটি জাহাজ একদিন অলস বসে থাকলে অন্তত ১৫ হাজার ডলার এফওসি বা ফিঙড অপারেটিং কস্ট ব্যয় হয়; যা ঘুরেফিরে সাধারণ ভোক্তাদের ওপরই পড়ে।
বন্দরে দেখা দেওয়া জাহাজ এবং কন্টেনারজট নিরসনে দ্রুত ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়ার জন্য আমদানি–রপ্তানিকারকদের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। অন্যথায় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য সংকটে পড়বে বলেও তারা মন্তব্য করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। জটের কারণে চাপে পড়তে হলেও বন্দরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারী এবং অপারেটররা জট নিরসনে সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন।