কাল আজ কাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৮:৫৩ পূর্বাহ্ণ

দুতিন বছর আগের কথা। বাসা থেকে বের হবার পথে গলিতে দেখলাম এক যুবক এক হাতে মোবাইল ধরে অন্য হাতে ইশারায় কিছু বোঝাচ্ছে কাউকে। আমি একটু থমকে গেলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম ব্যাপারটি। তবে বেশিক্ষণ লাগল না। বুঝে গেলাম যুবকটি বাকপ্রতিবন্ধী। ভিডিও কলে কারো সঙ্গে ইশারা ভাষায় কথা বলছে।

আমি কতদিন ভেবেছি এদের কথা। যারা কথা বলতে পারে না তারা ফোন বা মোবাইলের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কারণে কী অসাধ্য সাধন হয়েছে। একজন বাকপ্রতিবন্ধী কত সহজে ভাব বিনিময় করতে পারে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষের সঙ্গে, দুজনের কাছে একটি করে স্মার্ট ফোন থাকলেই হলো। আমার চোখ ভিজে গেল। আহা বিজ্ঞান! মানুষের জন্য কত সুবিধা ও সম্ভাবনার দুয়ারই না খুলে দিয়েছে। এতকাল সামনাসামনি ছাড়া দুজন বাকপ্রতিবন্ধীর ভাব বিনিময় সম্ভবই ছিল না।

বাকপ্রতিবন্ধীদের মধ্যে সর্বজনীন ভাব বিনিময়ের জন্য যে পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়েছে, যাকে আজ আমরা ইশারা ভাষা বলছি তার ইতিহাসও খুব বেশি পুরনো নয়। তবে এটাও অগ্রসর মানুষের চিন্তার ফসল। এটাও বিজ্ঞান।

আধুনিক ইশারা ভাষা সামপ্রতিক বললেও মানুষের আদি ভাষা কিন্তু ইশারাই ছিল। কারণ, একসময় মানুষ ভাষা আবিষ্কার করতে না পারায় পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতো ইশারায় এবং কিছু শব্দের মাধ্যমে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ভাষা আবিষ্কার একটি বড় মাইলফলক। তবে ভাষা আবিষ্কার হলেও বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধীরা বরাবরই ভাব বিনিময় করেছে ইশারায়। তবে তাদের সে ইশারা সর্বজনীন ছিল না বিধায় এক অঞ্চলের লোক অন্য অঞ্চলের ইশারা বুঝতো না।

আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্‌গুয়েজ (এএসএল ও বিএসএল) কে মৌলিক ধরে বিভিন্ন দেশে সৃষ্টি হয়েছে আলাদা সাইন ল্যাঙ্‌গুয়েজ বা ইশারা ভাষা। আমাদের দেশের বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বাংলা সাইন ল্যাঙ্‌গুয়েজ বা বাংলা ইশারা ভাষায় ভাব বিনিময় করে থাকে। যেহেতু আমরা ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, তাই ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্‌গুয়েজের একটা বড় প্রভাব রয়েছে বাংলা ইশারা ভাষার ওপর।

এই বাংলায় প্রথম ১৯৬৩ সালে কয়েকজন শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি গড়ে তোলেন ডিজঅ্যাবল পারসন অর্গানাইজেশন। বেসরকারি জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কানে শুনতে পায় না, কথাও বলতে পারে না। তাদের বলা হয় বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী । তাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হলো ইশারা ভাষা। এখন একটি গ্রহণযোগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত ইশারা ভাষা প্রচলিত হওয়ায় বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধীরা টেলিভিশনের সংবাদ থেকে শুরু করে ইশারা ভাষাযুক্ত যে কোনো কনটেন্ট বুঝতে পারে, উপভোগ করতে পারে।

ইশারা ভাষা প্রচলনের ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা পালন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ৭ ফেব্রুয়ারিকে ‘বাংলা ইশারা ভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে প্রধানমন্ত্রীর যেকোনো ভাষণ ও বক্তব্য ইশারা ভাষায় উপস্থাপন করা হয় যাতে তাঁর কথা শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও বুঝতে পারে।

বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ কিছু টিভি চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ইশারা ভাষায় সংবাদ পরিবেশনসহ বিভিন্ন তথ্য প্রচার করা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। সে ধারাবাহিকতায় দেশে ‘বাংলা ইশারা ভাষা দিবস২০২৩’ পালিত হয়েছে গত মঙ্গলবার। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিযয় ছিল, ‘বাংলা ইশারা ভাষা প্রচলন, বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবনমান উন্নয়ন’।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রযোজনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ইশারা ভাষায় ধারণ করা হয়েছে। যুগান্তকারী ‘ব্রেইল’ আবিষ্কৃত হওয়া ছিল একটি বড় ঘটনা। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা পড়তে পারবে? লিখতে পারবে? এ ধারণা পাল্টে দিয়েছে ব্রেইল আবিষ্কার। আজ ব্রেইলের মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা যেকোনো বিষয় পড়তে পারছে। তারা শুধু সাধারণ শিক্ষা নয়,উচ্চশিক্ষারও সুযোগ পাচ্ছে। ব্রেইলের পথ ধরে এখন আরও অনেক বিকল্প তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সহায়তা করার জন্য। এছাড়া বর্তমানে তথ্য ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে তাদের অধিকতর সুবিধার লক্ষ্যে তৈরি করা হচ্ছে আধুনিক কিছু অ্যাপ্লিক্যাশন সফটওয়্যার।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি করা সফটওয়্যারগুলো বিভিন্ন ডিভাইস ও কাজের ধরন অনুসারে বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে অপারেটিং সিস্টেম, অডিও বুক, স্ক্রিন রিডার, অ্যাক্সেসিবিলিটি অ্যাপ্লিকেশন, অনলাইন ভিত্তিক অ্যাপ ও জব অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাপ।

সফটওয়্যারগুলোর কাজের ধরনে পার্থক্য থাকলেও তাদের মূল কার্যনীতি প্রায় একই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য তৈরি করা এসব সফটওয়্যার সাধারণত দুটি ভাগে কাজ করে। প্রথমত, এরা স্ক্রিনের লেখাকে উচ্চারণের ধরন অনুসারে শব্দে রূপান্তরযোগ্য ডিজিটাল সিগন্যালে পরিণত করে এবং পরবর্তীতে সেটি ব্যবহার করে দৃষ্টিহীন ব্যক্তিকে লেখাটি পড়ে শোনায়।

বাংলা ভাষায় ব্রেইলের ব্যবহার আরো একধাপ এগিয়ে গেছে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এ সফটওয়্যার সরাসরি বাংলা থেকে ব্রেইলে অনুবাদ করে দেবে ভাষাকে। এতে দেশে ব্রেইল বইয়ের যে অভাব রয়েছে তা অনেকাংশে কমে যাবে বলে আশা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলা থেকে ব্রেইলে অনুবাদের এ যুগান্তকারী আবিষ্কারটি করেছেন ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।

এ সফটওয়্যারের কল্যাণে এ সংক্রান্ত বই সহজে কম খরচে এখন সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। স্বাভাবিক মানুষের জন্য লেখা বই দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা পড়তে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল বই। এ ডিজিটাল বইয়ের মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা পড়তে সক্ষম হবে।যে ব্রেইল পদ্ধতির কথা বললাম তার উদ্ভাবন ১৮২৫ সালে। ফ্রান্সের এক অন্ধ ব্যক্তি লুইস ব্রেইল যার নাম, তিনি এটি আবিষ্কার করেন ।

শুরুতে বলেছিলাম কিছু মানুষের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে বারবারই হার মেনেছে অসম্ভববা ইম্পসিবল। এই মহান ব্যক্তিরাই ইম্পসিবলকে পসিবল করে তুলেছেন। ব্রেইল পদ্ধতির উদ্ভাবক মহান ব্যক্তিটির নাম লুইস ব্রেইল। জন্ম ৪ জানুয়ারি ১৮০৯ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের এক ছোট্ট শহরতলীতে। ছোট বয়সেই তিনি চলে যেতেন তার বাবার ওয়ার্কশপে, সেখানকার বিভিন্ন যন্ত্রপাতিই ছিল তার খেলনা।

খেলতে খেলতেই তিন বছর বয়সে একদিন মুচিদের জুতো সেলাইয়ের কাজে ব্যবহৃত সুঁচ এক টুকরো শক্ত চামড়াতে ঢোকাতে গিয়ে দুর্ঘটনাক্রমে তার চোখে ঢুকে যায়। স্থানীয় ও প্যারিসের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেও চোখটি সারিয়ে তুলতে পারেননি, সে সময় অ্যান্টিবায়োটিকের আবিস্কার না হওয়ায় ব্রেইলের অন্য চোখেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে এবং এক সময় তিনি পুরোপুরিভাবে অন্ধ হয়ে যান।

ব্রেইল যে পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেন তার অনুপ্রেরণা আসে নেপোলিয়নের সময়ে চার্লস বারবিয়েরের মাধ্যমে। বারবিয়ের এক ধরনের চিহ্নভিত্তিক ভাষা বের করেন যেটি নিশ্চুপে বা রাতে সৈন্যরা একে অপরের কাছে পাঠাতে পারে। হাতের স্পর্শের মাধ্যমে বিভিন্ন ডট দিয়ে এ ভাষা বোঝা যেত। এ ভাষার নাম ছিল নাইট লেখনি। পরে বারবিয়েরের নাইট লেখনিকে মডিফাইড করে ব্রেইল সৃষ্টি করেন ব্রেইল সিস্টেম। এ ব্রেইল সিস্টেম অন্ধদের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী একটি ভাষা ব্যবস্থা। স্পর্শের মাধ্যমে উপলব্ধি করার এ পদ্ধতি আসলেই অসাধারণ।

ছোটবেলায় বহুবার পড়তে হয়েছে, ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগআসলে তা মস্ত বড়ো ভুল। বিজ্ঞান শুধু বেগই দেয়নি, মানুষের জীবনকেই আদ্যোপান্ত পাল্টে দিয়েছে। মানুষকে জীবন দিয়েছে, স্বস্তি দিয়েছে, আরোগ্য দিয়েছে।

একজন বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী যখন শুধু ইশারায় দূরভাষে ভাব বিনিময় করে কিংবা একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী যখন শুধু স্পর্শের মাধ্যমে পড়তে পারে, লিখতে পারে, জানতে পারে তখন তাদের যে অনুভূতি হয়, তখন যে আবেগ তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয় তার তুলনা কী দিয়ে হতে পারে।

একজন সুস্থ বা স্বাভাবিক মানুষ তাদের সে আবেগকে স্পর্শ করার ক্ষমতা তো রাখে না। একদিন মানুষ যাকে নিয়তি বলে মেনে নিয়ে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে দ্বারে দ্বারে ঘুরতো, একদিন যা দেবতা বা ঈশ্বরের অভিশাপ বলে ধরে নিয়ে হীনসম্মন্যতায় ভুগতো তাদের জীবনে বিজ্ঞান আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

এখানেই বিজ্ঞানের জয়, এখানেই বিজ্ঞানের সর্বজনীনতা।

লেখক : কবি সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধষাট দশকের ছাত্র আন্দোলনের অনির্বাণ দীপশিখাটি নিভে গেল
পরবর্তী নিবন্ধডাম্পারের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী শিক্ষার্থীর মৃত্যু