চাল নিয়ে প্রতারণা চলছে, অথচ শাস্তি নেই
১। চাল কিনতে যাবেন দোকানদার দেখাবে মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাজল, কাটারিপাইজার নামের চাল। চালের বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে সাংবাদিকরাও এ নামগুলোই লেখেন। অথচ বাংলাদেশে বা বিশ্বের কোথাও এসব নামে কোনো ধান উৎপাদন হয় না। এসব নামে যেসব চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে, তা একই জাতের ধান থেকে তৈরি। পত্রিকাসূত্রে জানা গেছে, ‘নাইজার শাইল’ নামে এক ধরনের ধান স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হলেও তা পরিমাণে এতই কম যে বাজারে খুব একটা পাওয়াও যায় না । তবে পাইজার নামে একটি ইরি ধান আছে, এটি অপেক্ষাকৃত সরু চাল। কিন্তু কাটারিপাইজার বলে কোনো ধান নেই।
আসলে ‘ব্রি–২৮’ ও ‘ব্রি–২৯’ ধানের চালই বাজারে বিক্রি হচ্ছে এসব নামে। স্থান–কাল–পাত্রভেদে একই চাল ভিন্ন ভিন্ন নামে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী প্যাজেটজাত হচ্ছে আড়তগুলোয়। যে চাল কুষ্টিয়ায় ‘নাজিরশাইল’ হিসাবে বস্তায় ঢুকছে, একই চাল বগুড়ায় ‘মিনিকেট’, শেরপুরে হয়ত ‘কাজল’ নামে ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির নামে ব্র্যান্ডেড হচ্ছে । ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিএডিসি ও কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে উৎপাদিত চালের ৮৫ শতাংশই মোটা। মাত্র ১৫ শতাংশ চিকন চাল।
চালকল মালিকরা সে মোটা চালকে চিকন করে মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাজল বা অন্যকোনো নামে বাজারজাত করছে। এতে ক্রেতারা শুধু প্রতারিতই হচ্ছেন না, চালের মূল যে পুষ্টি তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন ।
২। একটি সময়ে যখন গ্রামে ছিলাম মা–বাবা ভাই–বোন মিলে সে সময় পরিবারের সবমিলিয়ে ১৬/১৭ জনের সারা বছরের চাল আসতো নিজেদের জমির ধান থেকে। আমাদের নিজেদের চাষাবাদ ছিল না। বর্গাচাষীরা সেসব জমি চাষ করতেন। কানিপ্রতি নির্দিষ্ট আড়ি (চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে চাল মাপার একটি পরিমাপক) ধান প্রদানের শর্তে কৃষকরা আমাদের জমি চাষ করতেন। এটি গ্রাম বাংলার হাজার বছরের পদ্ধতি ও সংস্কৃতি। সে সময় দেখতাম কৃষকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। কে আরও বেশি আড়ি ধান দেবে। আরও বেশি বর্গাচাষ করবে। অনেকে ধানের পরিবর্তে একটি হিসাব করে টাকার বিনিময়েও জমি বর্গা দিতেন।
ধান বা চাল সুপ্রাচীনকাল থেকে কোটি কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য। চীন ও জাপানের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ১০,০০০ বছর আগে ধান চাষ শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। প্রাচীন কাল থেকে বাংলাদেশে তিনটি ধানের মৌসুম চলে আসছে– আউশ, আমন এবং বোরো। গত শতকের ষাটের দশকে সেচ নির্ভর ইরি–বোরো ধান প্রবর্তনের আগে পর্যন্ত আমন এবং আউশ ছিল প্রধান দুটি ধান। এ ধান সমতল, জলাভূমি ছাড়াও পাহাড়ী অঞ্চলেও আবাদ হয়। জুম চাষের এক অন্যতম ফসল হলো আউশ ধান।
৩। আমাদের বাড়িতে একটি গোলা ছিল। তবে সেটার ভিতরে বড়রা ঢুকে ধান বের করতেন, ছোটরা ঢুকতে পারতো না। উঁচু ও পাকা স্তম্ভের ওপর টিন দিয়ে তৈরি গোলার ভেতরটি ছিল মসৃণ কাঠের। এটাতে ছোট একটি দরজা থাকতো শুধু। সে ছোটবলাতেই শুনেছি গোলার কোন অংশে আমন ধান, কোন অংশে আউশ, কোন অংশে ইরি ধান থাকবে সে নির্দেশনা দিতে। এছাড়া বালাম, কালাজিরা ও বিনি ধানও আলাদা করে রাখা থাকত। সে সময় অনেকে আমন ছাড়া আউশ খেতে চাইতেন না। অধিক ফলনের তাগিদে ইতিমধ্যে আমাদের আদি ও দেশীয় অধিকাংশ ধানের জাত হারিয়ে গেছে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে–পরে এদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ থেকে আট কোটি। তার পাশাপাশি দেশে তখন আবাদি জমির পরিমাণ ছিল বর্তমান সময়ের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি। তারপরও দেশের খাদ্য উৎপাদন মোট চাহিদা পূরণ করতে পারতো না। খাদ্য আমদানিকারক দেশের শীর্ষে ছিল বাংলাদেশের নাম। তখন দেশের অনেক জেলায় মঙ্গা হতো। বেশ কয়েকমাস দেশজুড়ে থাকতো প্রবল খাদ্যাভাব। ধীরে ধীরে সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে জনসংখ্যা ১৭ কোটির অধিক। নদীভাঙন, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণের কারণে আবাদি জমির পরিমাণ অন্তত ৩৫ শতাংশ কমেছে। তারপরও দেশ ধান উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটা সম্ভব করেছেন বাংলাদেশের কৃষকরা। আর নতুন নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করে দেশের কৃষিখাতকে পাল্টে দিয়েছেন আমাদের কৃষি গবেষকেরা। তাঁরা উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে পানিতে টিকে থাকার মতো ধানের জাত, লবণাক্ত মাটিতে উৎপাদন হয় এমন ধানের জাত উদ্ভাবন করে দেশ ও জাতির অশেষ উপকার করেছেন। কৃষিজাত পণ্য যেমন, মাছ, হাঁস–মুরগি, গরু–ছাগল, সবজি, ফল উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন। এখন তাঁরা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কম শর্করাযুক্ত চালসহ আরও পুষ্টিসমৃদ্ধ চালের জাত উদ্ভাবনে কাজ করছেন।
৪। ক্রেতাদের ঠকানো বন্ধ করতে বস্তায় ধানের জাত, মিলের ঠিকানা ও দাম লেখা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে গত ২১ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে। এই নির্দেশনা পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) থেকে কার্যকর করতে বলেছিল মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখনো সরকারের দেওয়া এই নির্দেশনা অন্তত চট্টগ্রামে কার্যকর হয়নি বলে আজাদীতে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। তাতে বলা হয়েছে, গত বুধ ও বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরের চাক্তাইয়ে বেশ কয়েকটি রাইস মিল ও চালের গুদাম এবং চালের পাইকারি বাজার পাহাড়তলীতে ঘুরে কোথাও চালের বস্তায় ধানের জাত ও মিল গেটে চালের দাম লেখা দেখতে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে মিল মালিক ও চালের আড়তদারদের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। দেশের কোথাও এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। চালের বস্তায় মিলের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর এই তিনটি লেখা থাকে। কিন্তু তারিখ ও মূল্য লিখতে গেলে আমরা চাল বিক্রি করতে পারব না। বাজারে চালের দাম ওঠানামা করায় বস্তায় মূল্য লিখতে পারছেন না বলে জানান তারা। তবে মিল মালিক ও চালের আড়তদারদের সঙ্গে একমত নন অনেক দোকানদার।
মিল মালিকদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে দিনাজপুর থেকে আনা চাল ঢাকায় একদামে, চট্টগ্রামে একদামে, টেকনাফে আরেকদামে বিক্রি করতে হবে পরিবহন ব্যয়ের কারণে। এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না কারণ কোনো কোম্পানি জায়গাভেদে দাম নির্ধারণ করে না। দাম নির্ধারণের সময়ই পরিবহন ব্যয়ের হিসাবটি সমন্বয় করে নেন। কোম্পানি প্যাকেটেই এমআরপি অর্থাৎ ম্যাঙ্মিাম রিটেইল প্রাইস উল্লেখ করে দেন। প্যাকেট ও বোতলজাত সবকিছুর যদি এমআরপি নির্দিষ্ট করা যায় তাহলে চালের ব্যাপারে ব্যতিক্রম হবে কেন?
বহু আগে ঢেঁকি তারপর স্থানীয় ধানকলে ধান ভানতো কৃষক ও গৃহস্তরা। গ্রামের হাটবাজারে কৃষকরা ধান মিলিং করে নিজেরাই বিক্রি করতো। ছোট ছোট মিলমালিকরা ধান সংগ্রহ করে মিলিং করে আড়তে বসে বিক্রি করতো। এখন তা চলে গেছে কর্পোরেট হাউজের হাতে। বড় বড় কয়েকটি কোম্পানি ধান কিনে মজুত করে, মিলিং করে এবং সুদৃশ্য প্যাকেটে মনের মাধুরী মিশিয়ে নাম বসিয়ে বাজারে ছেড়ে দেয়। এরা একই সঙ্গে দুটো অপরাধ করছে। প্রথমত, চিকন চাল বানাতে গিয়ে চালকে এমনভাবে ছাঁটছেন যে তাতে ধানের খাদ্যগুণ নষ্ট হচ্ছে। এভাবে ধান ছেঁটে ফেলার ফলে প্রচুর অপচয়ও হচ্ছে। এর পরিমাণ প্রায় ৫২ লাখ মেট্রিকটন। দ্বিতীয়ত, একই ধানে মনগড়া নাম বসিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। ধানের নামে চাল বাজারজাত না করা, ধান ছেঁটে খাদ্যগুণ নষ্ট করা এবং বছরে অর্ধকোটিরও বেশি ধান অপচয় করার অপরাধে এদের শাস্তি হওয়া উচিত।
কারণ এরা আইন মানছেন না। ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেই চলেছেন। কিন্তু সরকার তাদের আইন মানতে বাধ্য করতে পারছে না। শাস্তিও দিতে পারছে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ যাদের পক্ষে কথা বলবার আসলে কেউ নেই।
লেখক : কবি–সাংবাদিক