পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব যেভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিষয়ে অবস্থান নিয়েছে, তা সাহস যোগাচ্ছে বলে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্ব গণতন্ত্রের জন্য যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার ওপর আস্থা রাখতে হবে। গত রবিবার ঢাকার গুলশানে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দেশীয়–আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের ভূমিকা ও এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় শীর্ষক সেমিনার এবং ‘নো কমেন্টস’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন ।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ফখরুল ইসলাম আলমগীর পশ্চিমা বিশ্ব বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছেন। বাংলাদেশে যতবারই সাধারণ নির্বাচন আসে ততবারই ওই রাষ্ট্রটি বিএনপি এবং তার সমমনা দলগুলোকে বিজয়ী করে ক্ষমতায় আনতে চেয়েছে। কিন্তু তারা পরপর তিনবারসহ মোট চারবার (১৯৯৬ সালের নির্বাচন) ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য মার্কিনীদের ব্যর্থতার ইতিহাস আরও পুরনো। ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে ওই রাষ্ট্রটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মূলত আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করছে।
আমি এখন অতীতে যাচ্ছি না। বর্তমান নিয়ে থাকছি। এখন বিশ্বের নজর মধ্যপ্রাচ্যের গাজার দিকে যেখানে প্রতিদিন নিরপরাধ বেসামরিক মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, বিশেষ করে সেখানে শিশু ও নারীরা অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ইসরায়েলের এই বর্বরোচিত আচরণকে প্রশ্নাতীতভাবে সমর্থন করে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো যাদের ওপর মির্জা ফখরুল আস্থা রাখতে বলেছেন।
গাজা হত্যাকাণ্ডে মার্কিনী ও তার মিত্র পশ্চিমাদের ভূমিকা নিয়ে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম একটি কলাম লিখেছেন গত শনিবার। সেখান থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘চলমান পরিস্থিতির মধ্যেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের কাছে মার্কিন ইতিহাসে সর্বোচ্চ এককালীন ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বরাদ্দ চেয়েছেন ইসরায়েল ও ইউক্রেনের জন্য।
গত মঙ্গলবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ইসরায়েল সফর করেছেন, যেদিন ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েল গাজায় বোমাবর্ষণ করে ৭০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন ইসরায়েল সফর করেছেন, ততদিনে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়েছে। অথচ, এই পরিস্থিতির মধ্যে মাখোঁ ও বাইডেন তাদের বক্তব্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে কেবল অনুরোধ করেছেন যে, যেন তারা ‘নিয়ম বহির্ভূতভাবে যুদ্ধ‘ না করে।
নির্বিচারে মানুষ হত্যা, শিশু হত্যা, পুরো জাতিকে গৃহহীন করা, গণ উচ্ছেদ, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন নিয়ে যদি কখনো ঠাট্টা–বিদ্রূপ করা হয়, তাহলেই কেবল এমন হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে ‘নিয়ম‘ মেনে চলার আহ্বান জানানো যেতে পারে।
পশ্চিমা নেতাদের কেউই এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি বা গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানাননি। এমনকি ব্রাজিলের নেতৃত্বে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ‘মানবিক কারণে যুদ্ধ স্থগিত’র প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু সেটা যুদ্ধবিরতি নয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ‘সাময়িকভাবে‘ নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বন্ধ রেখে চরম দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া। গত ১৮ অক্টোবর ফ্রান্সসহ নিরাপত্তা পরিষদের বাকি সব সদস্য এই প্রস্তাবে একমত হলেও যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ভেটো দেয়। এরপর গত ২৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে যুদ্ধ স্থগিত রাখার প্রস্তাব দিলে সেখানে ভেটো দেয় চীন ও রাশিয়া। হামাসকে ধ্বংস করতে ইসরায়েলকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। এমনকি এর জন্য যদি ২০ লাখ বাসিন্দাসহ গাজাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়, তাতেও তাদের সমস্যা নেই। এমন একটি পরিস্থিতিতে ‘নিয়ম‘ মানার আহ্বান কেবল লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই না।‘
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম নিয়ে বলতে গিয়ে মাহফুজ আনাম লিখেছেন, ‘দ্য ইকোনমিস্টের ১৪–২০ অক্টোবরের সংখ্যার প্রচ্ছদের শিরোনাম ‘ইসরায়েলের যন্ত্রণা’।
বিস্তারিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘আঘাত থেকে ক্রোধ‘ এবং অপর শিরোনাম ‘হামাসের নৃশংসতা ও ইসরায়েলের প্রতিশোধ উভয় পক্ষকে চিরতরে বদলে দেবে‘। যে ঘটনাকে জাতিসংঘ মহাসচিব ইতিহাসের ‘সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট‘ বলে অভিহিত করেছেন, সেই ঘটনায় ইকোনমিস্টের এই প্রতিবেদনে আস্থা রাখতে হলে মেনে নিতে হবে যে, হামাসই সব অপরাধ করেছে এবং ইসরায়েল শুধু জবাব দিয়েছে। সেই জবাবও ঠিক ততটুকু, যতটুকু না দিলেই নয়। বিস্ময় নিয়ে ভাবছিলাম, এই প্রতিবেদন যারা প্রকাশক করছেন এবং আমরা কি একই গ্রহে আছি? যদি তাই হয়, তাহলে দৃষ্টিভঙ্গিতে এত পার্থক্য হয় কীভাবে? মানবিক মূল্যবোধের দিক থেকে চিন্তা করলে, হয় আমি, না হয় পশ্চিমের একটি অংশ মানবতা বিষয়টি ভুলে গেছে।
পশ্চিমা গণমাধ্যম বরাবরই আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত। সেটা আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হোক বা লন্ডন, প্যারিস থেকে প্রকাশিত হোক। এই গণমাধ্যমেই গত কয়েকবছর ধরে শেখ হাসিনা ও তার সরকারবিরোধী মিথ্যা, বানোয়াট ও অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশ করে আসছে সে বিষয়টি কি কখনও মাহফুজ আনাম সাহেব খেয়াল করেছিলেন? করেননি তবে ইউরোপের কেউ কেউ করেছেন। গত ১২ অক্টোবরের খবর, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ ও ধারাবাহিকভাবে ‘বিকৃত তথ্য উপস্থাপন’ মোকাবিলায় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যের পরিচালনায় এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১২ অক্টোবর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাংলাদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টাডি সার্কেলের যৌথ পরিচালনায় এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। গত সেপ্টেম্বরে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পাস হওয়া জয়েন্ট মোশন রেজ্যুলেশনসহ ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ বিষয়ে চালানো অপপ্রচার কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। সভায় মূল আলোচক ছিলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ। অন্যতম বক্তা হিসেবে ছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন। সংবাদ উপস্থাপনে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভূমিকা ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলে মনে করেন জানিয়ে ড. ক্রাহ বলেন, ‘এনজিওগুলো বেসরকারি সংস্থা হলেও প্রায় সব এনজিওরই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। কিছু সংস্থা হয়তো নিজস্ব স্বার্থে তথ্য বিকৃত করে প্রচার করে, যার ফল হয় ভয়াবহ।‘
এই আলোচনা অনুষ্ঠান যদি লবিস্টের দ্বারা আয়োজিত হয়ে থাকে তাহলে ধরে নিতে সরকারের বিপক্ষে যায় এমন সিদ্ধান্তগুলোও লবিস্ট কর্তৃক আয়োজিত। পশ্চিমা গণমাধ্যম কতটা মার্কিন প্রভাবাধীন তার উজ্জ্বল প্রমাণ দেখেছি ইরাক যুদ্ধে।
ইরাকের প্রেসিডেন্ট তার দেশে বিরোধীদের ঠেকাতে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করছে এবং ইরাকে বিধ্বংসী অস্ত্র মজুদ আছে এমন অজুহাত খাড়া করে ইরাক আক্রমণ করেছিল আমেরিকা নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট। পশ্চিমা মিডিয়ায় এমন প্রচার এবং আমেরিকা ও তার মিত্রদের সেই যুদ্ধ যে ভুল ছিল তা পরে স্বীকার করেছিল যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। এখন স্বীকার করলেও দুঃখজনক হচ্ছে ইরাকের যা ক্ষতি এবং যতটা ক্ষতি হতে পারে তার সবটাই সম্পন্ন হয়েছে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া হয়ে আমেরিকার এবারের লক্ষ্য বাংলাদেশ। সিরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে এই অজুহাতে সেখানেও অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে সে দেশে বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের যে দুটি রাষ্ট্রকে ব্যবহার করেছিল সে দু’টি রাষ্ট্র সৌদি আরব ও কাতার নিজেরাই চরম স্বৈরতান্ত্রিক দেশ। যেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে কখনো প্রশ্ন তোলেনি আমেরিকা। এক সময় মোল্লা ওমরকে খুঁজতে বিশ্বের যে কোনো দেশে হামলা চালানোর নীতি গ্রহণ করেছিল আমেরিকা, তারপর লাদেন এরপর আইএস জঙ্গি আর এখন তাদের ভাষায় গণতন্ত্র। যে আমেরিকা যুগে যুগে গণতন্ত্র হত্যাকারী সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতাকারী সে আমেরিকা এখন তাদের ভাষায় গণতন্ত্রবিরোধীদের সাংশ্যান দিচ্ছে।
এরই মধ্যে দেশের রাজনীতিতে এক কৌতুককর ঘটনা ঘটেছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ‘আত্মঘোষিত উপদেষ্টা‘ মিয়া জাহিদুল ইসলাম আরেফী বিমানবন্দর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে গ্রেফতার হয়েছেন। শনিবার (২৮ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আরেফী নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে নিজেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এসময় তার সঙ্গে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন উপস্থিত ছিলেন। একটি রাজনৈতিক দল আদর্শিকভাবে কতটা দেউলিয়া হলে এমন প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারে তা ভাববার বিষয়। এ বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখে কিছুটা অবাক হয়েছি। কারণ তিনি প্রতিদিন তো আমাদের সবক দিয়েই যাচ্ছেন। তবে বুধবারে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব লাগসই একটা জবাব দিয়েছেন। সেদিন পিটার হাস আবার সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার জবাব শেখ হাসিনা বলেন, ‘ডায়লগ করতে হবে! ট্রাম্প সাহেব আর বাইডেন কি ডায়লগ করতেছে? যেদিন ট্রাম্প সাহেব আর বাইডেন ডায়লগ করবে, সেদিন আমি করব। যেমন কুকুর তেমন মুগুর!
লেখক : কবি, সাংবাদিক