সুখী মানুষের শার্ট কিংবা ভেজালহীন খাদ্য
গল্পটি সবার জানা। তারপরও তুলে দিলাম আজকের লেখার বিষয়বস্তুর স্বার্থে। রাজা অসুখে ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরে। কত চিকিৎসক এলো–গেলো, কত ধরনের ওষুধ খাওয়ানো হলো কিছুতেই রোগ সারছে না। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, আয়ুর্বেদীয়, ইউনানী এমনকি ঝাঁড়ফুক, তাবিজ–কবজ কিছুতেই সুস্থ করে তোলা যাচ্ছে না রাজাকে। শেষে এক দরবেশ ধরনের লোক এসে বললেন, একজন সুখী মানুষের শার্ট যদি রাজাকে পরানো যায় তাহলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
ব্যস রাজার উজীর–নাজির, পাইক–পেয়াদা সবাই নেমে পড়লেন সুখী মানুষের খোঁজে। তাঁরা প্রথমে গেলেন রাজ্যের ধনী ও অভিজাত শ্রেণির লোকের ঘরে ঘরে। বলে, আপনারা তো সুখী মানুষ, আপনার একটা শার্ট দিন, রাজার চিকিৎসায় দরকার। ওরা বলে আমরা তো সুখী না। টাকা–পয়সা আছে কিন্তু মনে সুখ নাই।
তারপর ওরা শিক্ষকের কাছে যায়, শিক্ষার্থীর কাছে যায়, বুদ্ধিজীবীর কাছে যায়, ধর্মীয় নেতাদের কাছে যায়, দোকানদারের কাছে যায়, কৃষকের কাছে যায়, শ্রমিকের কাছে যায় সবাই বলে তারা কেউ–ই সুখী না। উজির–নাজির, পাইক–পেয়াদা রাজ্যে কোথাও সুখী মানুষ না পেয়ে হতাশ হয়ে গেল। তারা প্রাসাদে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। যাওয়ার পথে একদিন হঠাৎ দেখতে পেল রাস্তার পাশে বসে আছে একলোক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটি হতদরিদ্র। তারপর তাদের একজন কৌতূহলবশত লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি সুখী মানুষ? লোকটি বিনা দ্বিধায় জবাব দিল, হ্যাঁ, আমি সুখী মানুষ। রাজার লোকজনেরা খুব অবাক হলো। বলে কী? রাজ্যের এত বড় বড় মানুষ, এত ধনী, এত অভিজাত, এত জ্ঞানী–গুণী কেউই নিজেকে সুখী বলছে না আর রাস্তার পাশের লোকটি নিজেকে সুখী বলছে। রাজার লোকেরা বলল, শোন, রাজার লোকদের সঙ্গে মিথ্যা বললে গর্দান যাবে। লোকটি বলল, মিথ্যা বলে আমার কী লাভ। বলছি তো আমি সুখী মানুষ। এবার রাজার লোকজন খুশিতে আত্মহারা হলো। তারা ঢোল বাজাল, বাদ্য বাজাল। এবার উজির বললেন, তাহলে তো পেয়ে গেলাম। এবার আমাদের রাজা সুস্থ হয়ে উঠবেন। লোকটিকে এবার বলল তারা, শোনো, তোমার একটা শার্ট লাগবে। ওটা গায়ে দিলে রাজা সুস্থ হয়ে উঠবেন। লোকটা বলল, আমার তো কোনো শার্ট নাই। রাজার লোকেরা ভাবল, শার্টের দাম পাবে না ভেবে হয়ত বলছে শার্ট নাই। তারা বলল, শোনো, শার্ট কিন্তু বিনেপয়সায় নেব না। বিনিময়ে যা চাইবে তাই দেব। তুমি বুঝতে পারছ না তোমার শার্টের ওপর রাজার জীবন নির্ভর করছে। লোকটি আবার বলল, সত্যি খু্ঁজে দেখো আমার কোনো শার্টই নেই। এবার রাজার লোকজন খুবই অবাক হলো, কী আশ্চর্য! লোকটির একটা শার্ট নেই অথচ নিজেকে ভাবছে সুখী।
গল্পটি বলার কারণ হলো, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দেশে ভেজাল ছাড়া আসল জিনিস পাওয়া সুখী মানুষের শার্টের মতো দুর্লভ হয়ে উঠেছে। রাজ্যের বড় বড় ও অভিজাতদের দেখে রাজার লোকজন এদের সুখী মনে করলেও আদতে যেমন এরা সুখী নয় তেমনি দেশের নামীদামী হোটেল–রেস্তোরাঁ ও কোম্পানির চাকচিক্য দেখে মনে হয় এরা খাঁটি, এরা আসল কিন্তু বাস্তবে তা নয়। যতবার ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয় ততবারই এই নগ্ন সত্য বেরিয়ে আসে। সেটা হোটেল হোক আর হাসপাতাল হোক, সেটা মিষ্টির দোকান হোক আর ওষুধের দোকান হোক।
কয়েকদিন আগে পচা মাংস সংরক্ষণসহ চার অপরাধে বারকোড ফুড জাংশনকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ৩০ আগস্ট বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বি এম মশিউর রহমানের নেতৃত্বে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় বারকোড ফুড জাংশনে অভিযান পরিচালনা করে এই জরিমানা আদায় করা হয়।
চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রোপলিটন নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারহান ইসলাম পত্রিকাকে বলপছেন, অভিযানে বারকোড ফুড জাংশনের রান্নাঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য দ্রব্য প্রক্রিয়াকরণ, পচা মাংস ফ্রিজে সংরক্ষণ, অনুমোদনহীন ঘি ব্যবহার, কাঁচা ও রান্না করা মাংস একত্রে সংরক্ষণসহ নানাবিধ অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হওয়ায় নিরাপদ খাদ্য আইনে ৪ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
একইদিন ফুলকলিতেও অভিযান পরিচালিত হয়। নোংরা পরিবেশে খাবার তৈরি, লেভেলিং প্রবিধানমালা লঙ্ঘন, নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহারসহ বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ফুলকলিকে নিরাপদ খাদ্য আইনে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
বাকলিয়ায় অবস্থিত এ কারখানায় অভিযান চালিয়ে বাইরে চকচকে প্যাকেটে মোড়ানো খাবার তৈরির উপদানে ভেজাল মেশানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। মেয়াদ উত্তীর্ণ অবিক্রিত খাবার মার্কেট থেকে ফ্যাক্টরিতে ফেরত আসলে, তা তারিখ পরিবর্তন করে পুনরায় বাজারজাত করারও প্রমাণ পেয়েছে আদালত।
এই চিত্র দেখে আঁতকে ওঠার কিছু নেই। এরা আভিজাত্য বা ব্রান্ডিংয়ের আড়ালে মানুষকে দিনের পর দিন ঠকিয়ে যাচ্ছে। ভেজাল, বাসী ও মানহীন খাবার খাইয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আসলে ফুটপাতের হোক আর নামকরা অভিজাত হোটেলই হোক সর্বত্র একই অবস্থা বিদ্যমান। বাইরে যতই চাকচিক্য থাকুক না কেন রান্নাঘর বা ফ্যাক্টরির অবস্থা সবারই এক। এটা জানা যায় তখনই যখন অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে যতবার অভিযান চালানো হয় ততবারই যদি একই অবস্থা উঠে আসে তাহলে অভিযানের ফল কী পেলাম আমরা।
এর একটি ব্যাখ্যা আছে ক্যাবের সহসভাপতির কথায়। তিনি সংবাদপত্রকে বলেন, ‘কেবল জরিমানা নয়, খাদ্যে ভেজাল মেশানো প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। আইনে জরিমানা ও জেল দুটোই আছে। ঝামেলা এড়ানোর জন্য জরিমানার বিধান বেশি প্রয়োগ হয়। কিন্তু তাতে অপরাধ প্রবণতা কমছে না। জরিমানার টাকা তাৎক্ষণিক পরিশোধ করা হলে পরোক্ষভাবে ভোক্তা ও কর্মচারীদের কাছ থেকে তা আদায় করে নেন মালিকরা। এক্ষেত্রে খাবারে ভেজাল মেশানো অপরাধকে ভয়াবহ বিবেচনায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োগ করা উচিত। এমনকি ওসব প্রতিষ্ঠান সিলগালা করারও বিধান রয়েছে।‘
নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩–তে বলা হয়েছে, খাদ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর যেকোনো বিষাক্ত দ্রব্যের ব্যবহার না করা; খ. খাদ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইনে নির্ধারিত মাত্রার অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয় বা ভারী ধাতু ব্যবহার না করা; গ. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভেজাল খাদ্য বা খাদ্য উপকরণ উৎপাদন, আমদানি, বিপণন ইত্যাদি না করা; ঘ. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিম্নমানের খাদ্য উৎপাদন না করা; ঙ. খাদ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ধারিত মাত্রার অতিরিক্ত সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়াকরণ সহায়ক দ্রব্যের ব্যবহার না করা; চ. শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত তেল, বর্জ্য, ভেজাল বা দূষণকারী দ্রব্য ইত্যাদি খাদ্য স্থাপনায় না রাখা; ছ. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্য উপকরণ আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুত, সরবরাহ বা বিক্রি না করা; জ. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ধারিত মাত্রার অতিরিক্ত কীটনাশক বা বালাইনাশকের ব্যবহার না করা; ঝ. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুমোদন গ্রহণ ব্যতিরেকে বংশগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনকৃত খাদ্য, জৈব খাদ্য, ব্যবহারিক খাদ্য, স্বত্বাধিকারী খাদ্য উৎপাদন না করা; ঞ. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইনের অধীন নির্ধারিত পদ্ধতিতে মোড়কীকরণ ও লেবেলিং না করা; ট. মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত প্রক্রিয়ায় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন না করা; ঠ. রোগাক্রান্ত বা পচা মৎস্য, মাংস, দুগ্ধ বিক্রি না করা; ড. হোটেল রেস্তোরাঁ বা ভোজনস্থলে নির্ধারিত মানদণ্ডের ব্যত্যয়ে পরিবেশন সেবা প্রদান না করা; ঢ. ছোঁয়াচে ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি দিয়ে খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত, পরিবেশন বা বিক্রি না করা; ণ. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নকল খাদ্য উৎপাদন বা বিক্রি না করা; ত. খাদ্য ব্যবসায়ী কর্তৃক আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রির রসিদ সংরক্ষণ করা; থ. নিবন্ধন ব্যতিরেকে খাদ্যের আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রি না করা; দ. খাদ্য ব্যবসায়ী কর্তৃক খাদ্যসংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সহায়তা দান; ধ. খাদ্যদ্রব্য বিপণন বা বিক্রির উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপনে অসত্য বা বিভ্রান্তিকর তথ্য না দেয়া; ন. খাদ্যদ্রব্যের গুণগত মানবিষয়ক যেকোনো ধরনের মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রস্তুত, মুদ্রণ বা প্রচার থেকে বিরত থাকা।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯–এ যেসব কার্যকলাপকে অপরাধ গণ্য করা হয়েছে তা হলো– ক. আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও পণ্যে মোড়ক ব্যবহার না করা; খ. মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করা; গ. সেবার মূল্যের তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা; ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা; ঘ. ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা; ঙ. খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশ্রণ করা; চ. মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা; ছ. প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা; জ. ওজনে কারচুপি করা; ঝ. বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শন করা; ঞ. পরিমাপে কারচুপি করা; ট. দৈর্ঘ্য পরিমাপক কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপি করা; ঠ. পণ্যের নব প্রস্তুত বা উৎপাদন করা; ড. মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা; ঢ. সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্য করা এবং ণ. অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতা দিয়ে সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ঘটানো।
সমস্যাটি হচ্ছে এখানে। শুধু অর্থদণ্ড দিয়ে এই অপরাধকে থামানো যাবে না। এটা গুরু পাপে লঘু দণ্ডের মতো হচ্ছে। এই অপরাধ বন্ধ করতে হলে অপরাধীরা যাতে আর কখনো খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসা করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানাভাবে বিশদ লিখতে পারছি না। তাই ছোট্ট একটি অনুরোধ জানিয়ে লেখাটি শেষ করব। যেখানে অভিযান সেখানেই অনিয়মের সংবাদ পাচ্ছি। তাতে ধরে নিতে পারি দেশের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। অনুরোধ, এখন শুধু সুখী মানুষের মতো একটা খাঁটি প্রতিষ্ঠানের নাম চাই। তার নাম গায়ে জড়াব।
লেখক : কবি–সাবাদিক