কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৮ মার্চ, ২০২১ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

অনন্য বঙ্গবন্ধু দেদীপ্যমান বঙ্গবন্ধু
পাপ-পুণ্য বোঝাতে যদি ভালো আর মন্দ কাজকে বোঝায় তাহলে বলতে হয় বাঙালির হাজার বছরের পুণ্যের ফল শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন নেতার জন্ম হওয়া। প্রতিটি জাতিই কিছু ক্ষণজন্মা মানুষের জন্ম দেয়। এরাই স্বজাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেন, নিজ মেধা ও ওজস্বিতার গুণে জাতিকে মুক্ত করেন, জাতির ভাগ্য বদলে দেন, জাতিকে মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করেন। এঁদের কেউ রাজনীতির ক্ষেত্রে, কেউ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখে জাতিকে সমৃদ্ধ করেন।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, মহাত্মা গান্ধী, জর্জ ওয়াসিংটন, উইনস্টন চার্চিল, মাও সে তুং, মহামতি লেনিন, ফিদেল কাস্ত্রো, চার্লস দি গল, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, চে গুয়েভারা, আব্রাহাম লিঙ্কন, নেলসন ম্যান্ডেলা এঁরা আজ শুধু নিজ দেশেই নয় বিশ্বের সবদেশেই সম্মানীয়, পূজনীয়।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামও আজ উচ্চারিত হয় এই বিশ্ববরেণ্য নেতাদের নামের সঙ্গে। কারণ তিনি তাঁর জাতিকে এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ। বাঙালির কয়েকহাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি কখনো স্বাধীন জাতি হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে পারেনি। এ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও অনন্যতা বিশ্বের অন্য নেতাদের চেয়ে ভিন্ন এবং সেসঙ্গে অধিক মর্যাদাকর। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার তিনি জন্মেছিলেন একটি পরাধীন দেশে। ফলে তাঁকে দেশকে স্বাধীন করার মহৎ কাজের দায়িত্বটি পালন করতে হয়েছিল এবং সে কাজটি তিনি সম্পাদন করেছিলেন খুব অল্প সময়ে। এত অল্পদিনের আন্দোলন-সংগ্রামে একটি দেশকে স্বাধীন করার নজিরও বিশ্বে নেই। তিনি শুধু একজন জাতীয়তাবাদী নেতাই নন, একই সঙ্গে তিনি একজন বিপ্লবীও।
এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র হতো না। স্বাধীনতা কাকে বলে তা অনুধাবন করতে পারত না। শুরুতে বলেছিলাম প্রতিটি জাতির মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তির জন্ম হয় যাঁরা জাতির জন্য ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হন। বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন বাঙালি জাতির ত্রাতা হয়ে। মৃত্যুর পর যতই দিন যাচ্ছে ততই তাঁর বিশালতা পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং এভাবেই তিনি দেশ-কাল-সীমানা পেরিয়ে বিশ্বমানবতার মুক্তির প্রবক্তা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন।
তিনি যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আদর্শ ও চরিত্রের দিক দিয়েও তা ছিল অনন্য ও ব্যতিক্রমধর্মী। দ্বিজাতিতত্ত্ব বা সামপ্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাগ হওয়া ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে থেকে নতুন যে দেশটি স্বাধীন করলেন বঙ্গবন্ধু তা ছিল এ উপমহাদেশের রাজনীতির বড় ব্যতিক্রম, বড় পরিবর্তন। হিন্দুদের জন্য ভারত আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান এমন ধারণা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বাইরে তিনি একটি সম্পূর্ণ আলাদা রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করলেন যা সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ। যে রাষ্ট্রটির জন্মই হয়েছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সম্মিলিত আন্দোলন-সংগ্রামে এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।
সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটির জন্য বঙ্গবন্ধু চারটি মৌলিক নীতি গ্রহণ করেন। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সংবিধানের শুরুতে উৎকীর্ণ করেন ‘জনগণই হইবে প্রজাতন্ত্রের মালিক’। এই চার মূলনীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কারণেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল বলে আমি মনে করি অন্তত।
পাকিস্তানের ২৩ বছরে দেশে কখনো প্রকৃত গণতন্ত্র ছিল না। তিনি স্বাধীন বাংলার মূলনীতিতে গণতন্ত্রকে প্রথমে স্থান দিয়েছিলেন।
পাকিস্তান ছিল অসাম্যের দেশ। শোষক ও লুটেরা পুঁজিপতিদের দেশ। সম্পদের সুষম বণ্টন এবং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বিলুপ্ত করা এবং দেশের সম্পদের মালিক জনগণকে করার লক্ষ্যে সমাজতন্ত্রকে দ্বিতীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করেন।
দেশভাগের আগে ও পরে তিনি এই উপমহাদেশে সামপ্রদায়িকতাকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ফলে তিনি এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যার চেতনায় থাকবে অসামপ্রদায়িকতা। সব ধর্মের মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আর বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণ বা রেনেসাঁর যে প্রয়োজন তা তিনি অনুধাবন করেই এই জাতীয়তাবাদকে উজ্জীবিত করেছেন এবং জাতিগত ঐক্যের লক্ষ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর এই নীতিগুলো ছিল বৈপ্লবিক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের জন্য অনেকটা দুঃসাহসিক। কারণ তখন তো বটেই বর্তমানেও পূর্ণ গণতান্ত্রিক এবং এ ধরনের আদর্শ ও নীতিভিত্তিক কোনো মুসলিম রাষ্ট্র নেই বিশ্বে। ফলে একদিকে তিনি কট্টর মুসলিমদের বিরাগভাজন হয়েছেন অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র এবং দেশীয় পুঁজিপতিদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। এই দুই অপশক্তির অভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে তাকে নিহত হতে হয়। তাঁর হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই ঘাতকদের সেই উদ্দেশ্য আমরা লক্ষ্য করি। তারা সেদিন শুধু তাঁকে এবং পরিবারের সবাইকে হত্যা করে নিবৃত্ত হয়নি। তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মনিকেও হত্যা করেছিল। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশে থাকলে তাদেরও হত্যা করতো ঘাতকরা। কারণ বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার এমন কাউকে তারা বাঁচতে দিতে চায়নি। তাদের লক্ষ্যই ছিল দেশটির খোল-নলচে সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে। ভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা যদি না বাঁচতেন, তিনি যদি দেশে ফিরে দলের হাল না ধরতেন এবং শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে যেতে না পারতেন তাহলে আজ আমাদেরকে বাস করতে হতো মোশতাক, জিয়া, এরশাদের বাংলাদেশ নামক পাকিস্তানের ভাবাদর্শের একটি দেশে।
মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তাঁর কথা নানাভাবে নানাস্থানে উচ্চারিত হবে, তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হবে। তবে আমি মনে করি শুধু আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে নয়, তার আদর্শ ও নীতি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই তাঁকে সত্যিকার অর্থে শ্রদ্ধা জানানো যাবে। দেশে তো বটে বর্তমানে বিশ্বরাজনীতির জন্যও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতি আলোচিত হওয়া এবং তা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ শুধু আজ বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বের দেশে দেশে যেখানেই মানুষ নিগৃহীত হচ্ছে, শোষিত হচ্ছে, সামপ্রদায়িকতার শিকার হচ্ছে সেখানেই মুক্তির বারতা নিয়ে আসবে। কারণ মানুষের সার্বিক মুক্তিই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।
বিশ্বের অনেক নেতাই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। কিন্তু মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন একমাত্র নেতা, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাজেই যতদিন বিশ্ব জুড়ে মানুষের মুক্তির আন্দোলন থাকবে, মুক্তির লড়াই থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন, অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। মানবতার মুক্তিযুদ্ধে দেদীপ্যমান হয়ে থাকবেন।
লেখক : কবি সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ অর্থনীতির উত্তরণ এবং এর চ্যালেঞ্জসমূহ
পরবর্তী নিবন্ধ১৪৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একযোগে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার