বেগম রোকেয়া ছিলেন অদম্য, অকৃত্রিম, সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রগামী। সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণ দেখিয়ে নিজের কর্তব্য সমাধা করতে ব্যর্থ হওয়াকে নিতান্তই ঠুনকো অজুহাত বলে মনে করতেন তিনি। ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ নিবন্ধে বেগম রোকেয়া পাঠিকাগণের কাছে এক নাতিদীর্ঘ পত্র লিখেছিলেন, যার প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ ছিল ধিক্কার আর আঘাতে ভরা। তবে এই আঘাত যতটা না সমাজের প্রতি তার চেয়ে বেশি নারীজাতির প্রতি। সমাজে মেয়েদের দুর্দশা ও অধঃপতনে মেয়েদের ভূমিকা কোন অংশেই কম নয় বলে মনে করেন বেগম রোকেয়া। আদিকালে যখন সভ্যতার উদ্ভব হয়নি, সমাজবন্ধনের কোন কথা শোনা যায়নি তখন তো নারীদের এতো দুর্গতি ছিল না, পুরুষ নারীর স্বামী বা প্রভু ছিল না। সভ্যতার বিস্তার লাভের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেও নারী পিছিয়ে পড়ে কর্মে, শক্তিতে। সবচেয়ে দামি যা হারিয়ে ফেলে নারী, তা হল সম্মান, মর্যাদা। অবাক ব্যাপার, নারী নিজেই তা বুঝতে পারে না, বোঝার চেষ্টাও করে না।
পৃথিবী থেকে কাগজেকলমে দাসপ্রথা অনেক আগে উঠে গেলেও বিশ্বজুড়ে ঘরে ঘরে নারীরা দাসীর জীবন যাপন করে চলেছে। জাপানী স্ত্রীদের বিশ্বসেরা এই কারণে বলা হয় যে তারা স্বামীর প্রধান সেবিকা হয়েই বেঁচে থাকে। ভারতবর্ষ কি বঙ্গদেশী ললনারাও নিরন্তর সেবিকা বা দাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জীবন পার করে দেয়। তারা জানেইনা তারা পদদলিত, তারা জানেই না এই সমাজ ও জগৎসংসারে তাদেরও অনেক কিছু করার আছে, অনেক কিছু দেবার আছে। অতঃপর ‘অবলা’ উপাধিতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে আমাদের মেয়েরা, যা তাদের ক্রমান্বয়ে কর্মহীনে পরিণত করে। বিবেকবুদ্ধিকে বাঙবন্দী করে তারা মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে কখনও বাবা, কখনও স্বামী-পুত্র বা অন্য কোন পুরুষ আত্মীয়ের ওপর। নারীদের এই শর্তহীন আত্মনিবেদনে ক্ষুব্ধ রোকেয়া আমাদেরকে ভিখিরির সঙ্গে তুলনা করেছেন- ‘একদিকে ধনাঢ্য দানবীরগণ ধর্মোদ্দেশে যতই দান করিতেছেন, অন্যদিকে ততই অধম ভিক্ষুক সংখ্যা বাড়িতেছে। ক্রমে ভিক্ষাবৃত্তি অলসদের একটা উপজীবিকা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এখন আর তাহারা ভিক্ষা গ্রহণ করাটাকে লজ্জাজনক বোধ করে না’… ‘আমাদের আত্মাদর লোপ পাওয়ায় আমরাও অনুগ্রহ গ্রহণে আর সংকোচ বোধ করি না… সুতরাং আমরা আলস্যের প্রকারান্তরে পুরুষের দাসী হইয়াছি। ক্রমশ আমাদের মন পর্যন্ত দাস (বহংষধাফ) হইয়া গিয়াছে।’
কোমলমতি বলে সৌন্দর্যের প্রতীকও নারী! তাইতো সোনাদানা হীরে জহরতে গড়া জড়োয়া পেঁচিয়ে নারীজনমের সার্থকতা খুঁজে পায় অনেক নারী! অলংকার পরাকে রোকেয়া টাকার শ্রাদ্ধ বলে মনে করতেন। অলংকারকে তিনি ‘দাসত্বের নিদর্শন (নধফমব ড়ভ ংষধাবৎু)’ বলেছেন। বিহারের এক ধনী মুসলমান ঘরের বধু সিঁথি থেকে শুরু করে চরণযুগল অবধি সর্বাঙ্গে সের আটেক স্বর্ণনির্মিত অলংকার পরিধান করে চলতে ফিরতে পারেন না। জড় পদার্থের মতো ঠায় বসেই দিন পার করে দেন এবং অল্পদিনে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। রোকেয়ার ভাষায়, ‘আমরা এমন জড় অচেতন পদার্থ হইয়া গিয়াছি যে, তাঁহাদের গৃহসজ্জা (ফৎধরিহম ৎড়ড়স এর ড়ৎহধসবহঃ) বই আর কিছু নহি।’ স্ত্রীগণ বুঝতেই পারেন না তাঁর শরীরের গহনা তাঁর স্বামীর ঐশ্বর্য ও গৌরবের পরিচয় বহন করে। একালে এমন করে সার্বক্ষণিক গহনা পরে থাকার প্রচলন না থাকলেও যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতে ভোলেন না অনেকেই। সারা বছর না হোক, বিয়ে বাড়িতে অন্তত স্বামীর ঐশ্বর্য ও গৌরবের প্রতিনিধিত্ব করতে ঐ পাথরখণ্ডগুলো বড় কাজ দেয় তাঁদেরকে।
দাসত্বের নিদর্শন মনে না করে অলংকারকে সৌন্দর্য বৃদ্ধির উপায়ও যদি মনে করা হয়, তাকে কি সাধুবাদ জানানো যায়? সৌন্দর্য বর্ধনের চেষ্টাও কি ‘মানসিক দুর্বলতা’ নয়? আমরা কি লক্ষ্য করে দেখেছি যে, কোন পুরুষ সৌন্দর্য বর্ধনের চেষ্টা করলে তাকে রমণীসুলভ বলে অপমান করা হয়? পুরুষের জন্য এ চরম পরাজয়। শেখ সাদির মতো মহান কবিও পুরুষদের বীর হতে উৎসাহিত করেছিলেন এই বলে- জয়ী হতে চেষ্টা কর, রমণীর পোশাক পরিওনা। তাই বলে রোকেয়া নিশ্চয় নারীদের বৈরাগ্য সাধন করতে বলেননি। শক্তিমত্তা, কর্মনৈপুণ্য, আত্মনির্ভরশীলতা ও আত্মমর্যাদাবোধ নারীকে কয়েক সের পাথরখণ্ড অঙ্গে চাপিয়ে স্বামী ও পরিবারের ঐশ্বর্যের বিজ্ঞাপনে উৎসাহিত করেনা- এই কথাটাই তিনি আমাদের নারীদের মর্মে মর্মে গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন, আর আমৃত্যু লড়াই করে গিয়েছেন। কারও অনুগ্রহ বা অনুকম্পা নিয়ে বেঁচে থাকায় গৌরব নেই- এই ছিল রোকেয়ার শিক্ষার মূলকথা।
বলতে বাধা নেই, এ বিষয়ে তিনি বড় একটা সফল হতে পারেননি। যথার্থ শিক্ষা ছাড়া মেয়েদের চোখ-কান খুলে দেওয়ার অন্য কোন পথ নেই বলে তিনি মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপন করেছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করেছেন, আর পরিণামে সমাজের অভিশাপ কুড়িয়েছেন। জীবনকালে তিনি নিন্দা কুড়িয়েছেন ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছ থেকে, সমসাময়িক আধুনিক পুরুষদের কাছ থেকে, আর নারীদের কাছ থেকেও। স্বয়ং মেয়েরাও চায়নি গহীন অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসতে, মানুষের মতো মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে। ঠিক যেন ‘যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর’।
বড় আক্ষেপ হয় একথা ভেবে যে, আজও আমরা মেয়েরা অনুগ্রহ আর অনুকম্পার আশায় হাত পেতে বসে থাকি। বিপদে আমাদের মস্তিস্ক কাজ করেনা। আমরা ধরে নেই, কেউ না কেউ এসে আমাদের উদ্ধার করবে। রোকেয়ার কালের মতো আমাদের কালেও ধনবান পরিবারের উচ্চশিক্ষিত, রূপবতী, আধুনিকা সামান্য আরশোলার ভয়ে কাবু হয়ে পুরুষসঙ্গীর সাহায্য প্রার্থনা করে। পুরুষগণইবা এই ‘নাকি কান্না’ নিয়ে বিদ্রুপের সুযোগ হাতছাড়া করবেন কেন! আমরা অবলীলায় বিদ্রুপ সয়ে যাই আর তাঁদের অনুগ্রহ পেয়ে ধন্য হই। অনুগ্রহ পেয়ে পেয়ে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত নারীগণ ক্রমে অকর্মণ্য ও অলস হয়ে সমাজের বোঝায় পরিণত হয়েছে। তীব্র ঘৃণা ফুটে ওঠে রোকেয়ার প্রতিটি লেখার পাতায় পাতায়। তাঁর স্বগতোক্তি ‘অনুগ্রহ করে এই কর, অনুগ্রহ কর না মোদের।’
হতদরিদ্র প্রান্তিক নারী, যারা প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে, তাঁদেরও বেগম রোকেয়া তথাকথিত ধনী, শিক্ষিত, রূপবতী নারীদের চেয়ে অধিক যোগ্যতা ও মর্যাদাসম্পন্ন, সাহসী এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে মনে করতেন। রোকেয়ার মতে, কেবল পাস করা বিদ্যা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারেনা। শিক্ষা যদি আমাদের ব্যক্তিত্বে, আচরণে বিবেক ও মর্যাদাবোধ ও কর্মস্পৃহা জাগিয়ে না তোলে, তবে সেই অন্তঃসারশূন্য শিক্ষায় আমাদের কোন কাজ নেই। এই ছিল রোকেয়ার দর্শন। তিনি ঘা মেরে সমাজের ঘুম ভাঙাতে চেয়েছিলেন।
পরিতাপের বিষয়, তিরোধানের নয় দশক পরও রোকেয়ার দর্শন গণমানুষের মনে বড় ধরনের কোন নাড়া দিতে পারেনি। আজকাল রোকেয়া দিবস পালিত হয় উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে বড় পরিসরে। এছাড়াও নারী দিবস, নারীপক্ষসহ নানান আয়োজন চলে বছর জুড়ে। রঙিন নারীদের ছবিতে সয়লাব খবরের কাগজ। উন্নয়ন, সভ্যতা, প্রযুক্তি, সর্বোপরি ক্ষমতার বড়াই করি আমরা কথায়-কথায়। উদযাপনের শেষ নেই দেশে দেশে। দিনশেষে সবই নাটকের মঞ্চায়ন বলে মনে হয়।
রোকেয়ার জীবনী এবং তাঁর রচনাবলী ও চিঠিপত্র পাঠের মাধ্যমে রোকেয়া চরিত্র উন্মোচিত হয় পাঠকের সামনে। জীবনযুদ্ধে বারবার হোঁচট খাওয়া, হার না মানা মানুষ রোকেয়া প্রেরণা ও শক্তির উৎস হয়ে বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে। কুসংস্কার নির্মূল করে সুস্থ ধারার মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অভিমত ছিল এই যে, অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় চাই সামজিক বিপ্লব। তবে আন্দোলন করতে না পারলেও আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। প্রতিটি রচনায় রোকেয়া আমাদের ভাবনার ঘরে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছিলেন। অথচ সর্বোচ্চ শিক্ষালয় হতে ভারী ভারী সনদ নিয়ে আমরা আজও তাঁকে ছুঁতে পারি না , প্রাণে ধরতে পারি না।
যেকথা না বললেই নয়, রোকেয়াকে নিয়ে কেবল নারীরাই চর্চা করে গেলে তাঁর জীবন, কর্ম, আদর্শ ও দর্শনকে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাই সমাজের প্রতি রোকেয়ার চাবুক মারা রচনাগুলো পাঠ করা আবশ্যক, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের।
salma_ctgu@yahoo.com