কাপ্তাই লেক ড্রেজিং করে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ২৭ জুন, ২০২৩ at ৯:৪১ পূর্বাহ্ণ

প্রায় দুই মাস ধরে চট্টগ্রামে সরবরাহ করা ওয়াসার পানি লবণাক্ত। তার উপর উৎপাদন অর্ধেক কমে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ কমে গেছে পানির। নগরের প্রায় সব এলাকায় পানির সংকটে হাহাকার দেখা দিয়েছে। যেটুকু পানি আসে লবণের কারণে তা মুখে দেওয়া যায় না। এ পানি পান করে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অনেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। শোধন করলেও পানির লবণাক্ততা যাচ্ছে না। অনেক এলাকায় নালার দুর্গন্ধযুক্ত, ময়লা ও কালো পানি পাচ্ছেন নগরবাসী। এতে অনেকে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন। তবে ওয়াসার দাবি কর্ণফুলী নদীতে শেওলা জমা, কাপ্তাই হ্রদে পানি কমে যাওয়া এবং কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে সমুদ্রের নোনা পানি প্রবেশের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলেন, মুষলধারে বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এ সংকটের সমাধান হবে না। নদীতে সমুদ্রের নোনা পানি ঢুকে পড়ায় ৬ ঘণ্টা পানি উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়েছে। আর শেওলার জন্য রাসায়নিক দিয়ে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্ণফুলী ও হালদা নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে পরিশোধনের মাধ্যমে তা শহরে সরবরাহ করে। এই প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার ১ ও ২ থেকে আসে ২৮ কোটি লিটার, শেখ রাসেল পানি শোধনাগার থেকে আসে ৯ কোটি লিটার, মোহরা পানি শোধনাগার থেকে আসে ৯ কোটি লিটার এবং গভীর নলকূপ থেকে আসে ৪ কোটি লিটার পানি। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করতে পারে বলে দাবি ওয়াসা, চাহিদাও ৫০ কোটি লিটার।

বর্তমানে চট্টগ্রামে ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক ৭৮ হাজার ৫৪২ জন, বাণিজ্যিক গ্রাহক ৭ হাজার ৭৬৭ জন। ৭৭০ কি. মি. পাইপলাইনের মাধ্যমে সংস্থাটি পানি সরবরাহ করে। তবে বেশিরভাগ লাইন পুরানো হওয়ায় সংকটে থাকতে হয় গ্রাহকদের। লাইন লিকেজের কারণে প্রচুর পানি নষ্ট হয়। ওয়াসা কর্তৃপক্ষের অভিমত অন্তত ৩০% পানি লাইনের কারণে অপচয় হয়। এর ফলে পানির সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করে।

এদিকে ওয়াসা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের হ্রদে পানির স্তর ৩৭ ফুট পর্যন্ত কমে গেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় পানির স্তর থাকে ১০৯ ফুট, বর্তমানে আছে প্রায় ৭২ফুট। পানির স্তর কমে যাওয়ায় পানির অভাবে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ৫টি টারবাইনের মধ্যে মাত্র ১টি (২৫ মেগাওয়াট) চালু রয়েছে। তবে পানির উচ্চতা ১০৮ ফুট থাকলে ৫টি ইউনিট থেকে মোট ২৪২ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।

এদিকে জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্তৃপক্ষ জানান কয়েক বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি পানি কমেছে হ্রদে। পানির স্তর ৭০ ফুটে নেমে আসলে একমাত্র চালু ইউনিটটিও বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ জল বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অতি অল্প। যেখানে কয়লা, তৈল বা গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ প্রতি ইউনিট ৬১৬ টাকা পর্যন্ত, সেখানে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিটে খরচ মাত্র ৫৪ পয়সা। তার উপর জল বিদ্যুৎ প্রকল্পটি পরিবেশ বান্ধব। কোনো প্রকারের পরিবেশ দূষণের আশংকা নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আরো ২টি ইউনিট (৬ ও ৭ নং ইউনিট) চালু করার সুযোগ রয়েছে, যাতে ৮০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সুযোগ আছে। এরপরও এই প্রকল্পটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো আগ্রহ নেই।

শুধু জলবিদ্যুৎ নয় কাপ্তাই লেকে পানির অভাবে রাঙ্গামাটি জেলার লেককেন্দ্রিক যোগাযোগ, ব্যবসা বাণিজ্য, মৎস্য উৎপাদন ও পর্যটনে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পানির অভাবে বেড়েছে রাঙ্গামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পানি পরিশোধনের খরচও। ছয় উপজেলা জুরা ছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল, লংগদু, নানিয়ার চর ও বাঘাইছড়ির নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এরমধ্যে জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি বরকল উপজেলার যোগাযোগ পুরাপুরি বন্ধ, কারণ এই তিন উপজেলায় যোগাযোগের আর কোনো মাধ্যম নেই।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি কমার এমন চিত্র আশংকাজনক। গত এক দশকের মধ্যে হ্রদের পানি এবারই সবচেয়ে বেশি তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। হ্রদের নাব্যতা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে সবখানে। যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে, ভোগ্যপণ্য পরিবহন খরচও বেড়েছে। উৎপাদিত ফসলাদি ও ফলমূল জেলা সদরে আনার ব্যয়ও বেড়েছে। অন্য দিকে হ্রদ থেকে পানি কম যাচ্ছে বলে সমুদ্রের নোনাপানি মোহরা ও রাঙ্গুনীয়া পর্যন্ত চলে এসেছে। হ্রদ ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে মৎস উৎপাদনেও। মৎস অবতরণ কেন্দ্র সুত্র জানায়, ২০১৯২০ সালে রাঙ্গামাটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে হ্রদ থেকে মাছ পাওয়া যায় ৮ হাজার ৫৬৩ টন। আর ২০২১২২ সালে পাওয়া যায় ৬ হাজার ৫২৩ টন, যা নিম্নগামী। এমনিতে শুষ্ক মৌসুমে প্রতিবছর তিনমাস মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়। পানি কম থাকায় গত বছর মাছ ধরা বন্ধ ছিলো চার মাস। এ বছর আরো বেশি সময় বন্ধ রাখতে হবে মাছ ধরা। এই বিষয়ে মৎস্য কর্মকর্তাদের অভিমত, পানির অভাবে অনেক জায়গায় হ্রদের প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ভরাট হয়ে গেছে। এজন্য মাছের উৎপাদন কমে গেছে ও মাছ বড় হতে পারছে না।

১৯৬২ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলে রাঙ্গামাটি জেলার ৭০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার বনাঞ্চল ও চাষযোগ্য জমি হ্রদের পানিতে তলিয়ে যায়। প্রায় দেড় লাখ মানুষ ভিটে হারা হয়। ভাবা হয়েছিলো এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কম খরচে ও সুলভে উৎপাদন করা যাবে বিদ্যুৎ। লেকের বিশাল জলরাশির ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ, পর্যটন ও মৎস্য উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন ছিলো লেকের যথাযথ পরিচর্যা ও পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো। কিন্তু সে আশা গুড়েবালি। গত ৬১ বছরে উজান থেকে বিপুল পলিমাটি এসে লেকের একটি বিরাট অংশ ভরাট করে ফেলেছে। তার উপর লেকের মধ্যে অবস্থিত অনেক নিমজ্জিত পাহাড় ও অন্যান্য উঁচু পাহাড় বৃষ্টির পানি প্রবাহে ধুয়ে লেকের তলদেশ ভরাট করে ফেলেছে। অথচ এক কোদাল মাটিও লেকের তলদেশ থেকে উত্তোলন করা হয়নি। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে লেকের পানি শূন্য এই করুণ দশা।

কর্ণফুলী নদী হলো একটি বহুমুখী নদী। বলা যায় বাংলাদেশের লাইফ লাইন। এই নদী ক্ষতিগ্রস্ত বা নাব্যতা হারালে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর অকেজো হয়ে যাবে। রাঙ্গামাটি জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। লবণাক্ত পানি ঢুকে কর্ণফুলী ও হালদা নদী তার স্বভাব সুলভ চরিত্র হারিয়ে ফেলবে। এতে করে হালদার প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন ও ডিম উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।

মনে রাখতে হবে, কর্ণফুলী নদীর পানি দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করা হয়। হাজার হাজার কল কারখানা ব্যবহার করে এই নদীর পানি। উজান থেকে কর্ণফুলী নদীতে পর্যাপ্ত পানি না আসলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও হালদা নদী পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করবে।তখন সুপেয় পানির অভাবে চট্টগ্রাম নগর একটি পরিত্যক্ত নগরে পরিণত হবে। ব্যবসা বাণিজ্য ইন্ডাস্ট্রি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই অতি দ্রুত কাপ্তাই লেকের বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। ড্রেজিং করে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তা না হলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়!

লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিবাহ বিচ্ছেদ দুটি জীবনের বিপর্যয়
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল