“হাঁড়ি নিয়ে দাড়িমুখো কে–যেন কে বৃদ্ধ,
রোদে বসে চেটে খায় ভিজে কাঠ সিদ্ধ
মাথা নেড়ে গান করে গুন্ গুন্ সংগীত–
ভাব দেখে মনে হয় না–জানি কি পণ্ডিত!
বিড়্ বিড়্ কি যে বকে নাহি তার অর্থ–
“আকাশেতে ঝুল ঝোলে, কাঠে তাই গর্ত।”
কোন্ কাঠে কত রস জানে নাকো তত্ত্ব–
একাদশী রাতে কেন কাঠে হয় গর্ত?
আশে পাশে হিজি বিজি আঁকে কত অঙ্ক–
ফাটা কাঠ ফুটো কাঠ হিসাব অসংখ্য;
কোন্ ফুটো খেতে ভাল, কোন্টা–বা মন্দ,
বলে, “জানি কোন্ কাঠ কিসে হয় জব্দ।
কাঠকুটো ঘেঁটেঘুঁটে জানি আমি পষ্ট,
এ কাঠের বজ্জাতি কিসে হয় নষ্ট।
কোন্ কাঠ পোষ মানে, কোন্ কাঠ শান্ত,
কোন্ কাঠ টিম্িটমে, কোন্টা–বা জ্যান্ত।
কোন্ কাঠে জ্ঞান নাই মিথ্যা কি সত্য,
আমি জানি কোন্ কাঠে কেন থাকে গর্ত।” (সংক্ষিপ্ত)
সুকুমার রায় ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। তিনি আমার বর্তমান অবস্থা বহুবছর আগেই এই ছড়ায় বলে গিয়েছিলেন! আমার মুখ কখনই photogenic ছিলো না, ছিলো হাঁড়ির মতই। তার উপরে দাড়ি তো আছেই বটে, পন্ডিত না হয়েও পন্ডিতের মতই মাথা নাড়ি আর মাঝে মাঝে নিজমনে গান গাই, বিড়বিড় করে হিসাব কষি। আশেপাশের কাগজে এবং কাঠে নানারকম হিজিবিজিও আঁকি। হুবহু মিল।
বছরখানেক ধরেই মাথায় আইডিয়াটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কোত্থায়ও সুস্থির হয়ে বসতে দিচ্ছিলো না। শেষমেশ, আইডিয়াটাকে বাস্তবায়ন করেও ফেললাম। ঘটনাটা হলো– শখের কাঠের–কাজ। কেন জানি মনে হতো, আমি কাঠ দিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস বানাতে পারবো। লোক–দেখানোর তেমন কোনো খায়েশই ছিলো না; শুধুমাত্র নিজমনের ইচ্ছাপূরণের জন্যই।
অবশ্য এরও একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। পনের–বিশ বছর আগে আমার খালাতোভাই পাপুল, ছোট্ট শহীদ–মিনার বানিয়ে ইউটিউবে ভিডিওটা দিয়েছিলো। একদম ছোট্ট, ডেস্কটপ–মডেল। আমার খুব ভালো লেগেছিলো, এবং কাঠ কিনে সেই সাইজেরই একটা বানিয়েও ছিলাম। কিন্তু আমারটা নিজেরই তেমন পছন্দ হয়নি। নাজমা যদিও প্রশংসা করতো, একুশের অনুষ্ঠানে নিতে বলতো। লজ্জায় আমিই নিতাম না। কিন্তু মাথার মধ্যে সুপ্ত–ইচ্ছা ছিলো, কোনো একদিন সুন্দর একটা শহীদ–মিনার বানাবো। বছরখানেক পরে, আমার বাসা রিমডেলিং–এর সময়ে, মিস্ত্রীর কাজ দেখে সেই সুপ্তবাসনা মাথাচাঁড়া দিয়ে উঠলো। কাঠ কিনে, তার যন্ত্রপাতি দিয়েই একটা চারফুট উঁচু শহীদ–মিনার বানালাম। আনাড়ি হাতের তৈরি, নড়বড়ে হলেও উৎরে গেলো। আমারও ভালো লাগতো সেটা। টলিডো ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশী স্টুডেন্ট্স্ এসোশিয়েশানের একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে খুব প্রশংসা কুড়ালো। আমার মাথায়ও উডওয়ার্কিংয়ের ভূত জাঁকিয়ে বসলো।
ইউরোপ–অ্যামেরিকায় অবসর সময় কাটানোর যে কতরকমের কত্তকিছু আছে, তার কোন ইয়ত্তা নাই। দৈনন্দিন কাজশেষে বিকেলবেলা বলেন, বা উইকএন্ডে, অথবা বাৎসরিক ভ্যাকেশান অথবা কর্মজীবনশেষে রিটায়ার্ড জীবনই বলেন। ম্যুভি–থিয়েটার, বইপড়া, সাইকেল চালানো, মাছধরা, নৌকাচালানো, হরিণ–ভাল্লুক–পাখি শিকার করা, হাইকিং–খেলাধুলা–স্পোট্র্স্, সেলাই–ফোঁড়াই, ড্রয়িং–পেইন্টিং, হাতেরকাজ বা ক্র্যাফট্স্, একেকজনের একেকরকমের শখ। সবকিছু পুরণেরই ব্যবস্থা আছে। বেশকিছু দোকানেই এসমস্ত শখপূরণের জন্য যাবতীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়– Hobby-Lobby, Michaels, Joan Fabrics, Hobby Town, Harbor Freight, Guitar Shop, Music Emporium, Bass Pro, Cabela’s, Gander Mountains ইত্যাদি, ইত্যাদি অনেক। ইলেক্ট্রনিক্সের জন্য এককালে ছিলো জধফরড় ঝযধপশ, এখন অন্য কম্পিউটারের দোকান আছে। যার যা হবি, তার কাছে সেটার সবধরনের সরঞ্জামই মজুদ থাকে। তারা ছোটবেলা থেকেই এগুলো করে করে বড় হয়েছে, স্কুলেও করেছে, আবার বাসাতেও করে।
যাই হোক, আমি মাথার ভূত নামাতে WoodCraft নামের দোকানে গিয়ে বেশ কয়েকঘন্টা কাটালাম। সেখানে জিনিসপত্র–টুল্স্ বিক্রির পাশাপাশি নানান ফ্রি–কোর্স দেয়, Basic Woodworking শিখায়, দোকানের সকলেই উডওয়ার্কিং–এ এক্সপার্ট। তাদের সঙ্গে কথা বলেই অনেক কিছু শেখা যায়, জানা যায়। নানান ত্বরিকা–পদ্ধতি বাৎলে দেয়, টিপ্স–ট্রিক্স্ দেখিয়ে দেয়। সেরকমই একজনকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ দেখিয়ে বললাম, এটা বানাবো, আমাকে গাইড করো। সে আমার উডওয়ার্কিং সম্পর্কে শূন্য–অভিজ্ঞতা, এবং নিজস্ব কোন যন্ত্র নাই শুনে হতাশ হলেও, অনেক উপদেশ দিলো, গাইড করলো কীভাবে কী করতে হবে। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার সে যখন এক একটা যন্ত্রের নাম বলে, আমি তার কোনোটাই চিনিনা। কোন্টা যে কী কাজ করে সেটাই জানিনা, সেগুলো ব্যবহার করা তো দূরের কথা। আমার বিদ্যার দৌড় তো বাসার ছোটখাট কাজে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠোকা বা স্ক্রু–ড্রাইভার ঘুরানো পর্যন্তই। কলেজিয়েট স্কুলে উডওয়ার্কিং–এর ক্লাস করেছিলাম; এরপরে ক্যাডেট কলেজে উডওয়ার্ক– মেটালওয়ার্ক ক্লাসও করেছি। কিন্তু সেগুলো সবই ভাসা ভাসা–পরীক্ষা পাশের জন্য। জাহাজে থাকতে ইঞ্জিন–জেনারেটর, অন্যান্য মেশিনারীজ নিয়ে কাজ করলেও, কাঠেরকাজ তো করিনাই।
WoodCraft–এ ঘন্টাখানেক সবক শেষে, হিসাব–নিকাশ করে দোটানায় পড়লাম। প্রচুর যন্ত্রপাতি লাগবে। ইন্টারনেটে উইন্ডো–শপিং করে বেড়াই, মাথা চুলকাই, অঙ্ক কষি, আড়চোখে হোম–মিনিস্টার নাজমার দিকে তাকাই। অনেক চিন্তাভাবনা করে, দুয়েকটা যন্ত্র অনলাইনে কিনলাম, কিছু দোকানে গিয়েও কিনলাম। শুরু করলাম Circular-Saw jigsaw(ইলেক্ট্রিকের গোল চাক্তি–করাত) দিয়ে। এরপরে router, jigsaw কিনে ফেললাম। ছোটখাট এটা–ওটা বানাতেও শুরু করলাম। নাজমাকে নৌকার শেইপে tea-candle holder বানিয়ে দিলাম। ইজানবাবুর নাম লিখলাম। সেগুলো দেখে সকলে খুশী। আমিও সেই খুশীর ঢেউয়ে একের পর এক যন্ত্রপাতি কিনেই চললাম। অনলাইনে দেখতাম কি কিনবো, রিভিউ পড়তাম, পরে আরাফা বা ভাইপো রাহীনের Amazon একাউন্ট থেকে অর্ডার দিতাম। এরফলে সকলের ইমেইল, ফেইসবুক, ইউটিউব একাউন্ট সবকিছুতেই কাঠের যন্ত্রপাতির বিজ্ঞাপনে ভরে গেলো। আজকাল এটা হবেই। আপনি গাড়ি কিনবেন চিন্তা করে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন, ব্যস অমনি সবধরনের গাড়ির অ্যাড আপনার চোখের সামনে যেইভাবেই হোক তুলে ধরবেই, ধরবে। ধারণা করা হয়, সবকিছুতে ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন থাকার জন্য, আজকাল আর সার্চ করারও প্রয়োজন পড়ে না। আপনি হয়তো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন আর পাশে রাখা আপনার স্মার্টফোন সেটা শুনতে পারছে, (মানে গুগল বা অন্য কেউ শুনছে)। ব্যস, আপনি সেই জিনিসের অ্যাড পাওয়া শুরু করবেন। প্রইভেসির মহাপ্রয়াণ!
যাক, যন্ত্রপাতি সব গ্যারেজে ফিট করা শুরু করলাম। এরফলে নাজমার গাড়ি ড্রাইভওয়েতে বের করে দিতে হলো। এতদিন আমাদের গাড়িগুলো বাইরে থাকতো। এখন নাজমারটাও। Mitre-Saw আসলো, আসলা Scroll-saw, Table Saw, Belt-Sander, Drill-Press, ছোটখাট আরো অনেক কিছুই সব মিলিয়ে প্রায় ছয়–সাত হাজার ডলারের যন্ত্রপাতি। Youtube দেখে অনেকেই রান্না–বান্না করে, আমিও Youtube দেখে কাঠেরকাজ শিখি।
এক ঈদে আমাদের বাসায়, টলিডোর বাংলাদেশীদের দাওয়াত ছিলো। তার আগে অনেকগুলো birdhouse বানিয়েছিলাম। বাচ্চাদেরকে দিলাম সকলে একটা করে রঙ করবে, তারপরে যে যারটা বাসায় নিয়ে যাবে। সেবারে বাচ্চাদের খুশী দেখে প্রাণটা ভরে গিয়েছিলো। আরেকবার করেছিলাম কাঠের পাখি–প্রজাপতি।
এরপরে আসতে থাকলো ফরমাস বা অর্ডার (সবই বিনি পয়সার)। আমাদের মেয়ে ঝোরার বিড়ালের জন্যে Cathouse, কিচেনে মশলার শেলফ, কফি–মগের র্যাক, কোট–র্যাক, সোফায় কফিমগ–হোল্ডার ইত্যাদি। ছেলে আরাফার ঘড়ি–সেলফোন হোল্ডার। রাহীন–দীশা বললো কিচেনের ছুরি ঝুলাবার জন্য magnetic knife holder, – সেটাও বানালাম। বেডে শুয়ে করার জন্য জাপানীজ টি–টেবিলের আদলে ল্যাপ্টপ–টেবিল। অনেককে গিফ্টও দিলাম। কারো জন্য ম্যাগাজিন হোল্ডার, কারো জন্য স্যুভেনির, হার্ট–শেইপের tea-candle holder, Yin-Yang candle-holder, পাতার শেইপে জুয়েলারি–বক্স। তবে সবচেয়ে বেশী বানিয়েছি আদরের ইজানবাবুর জন্য। শুরু করেছিলাম তার নাম দিয়ে। এরপরে করলাম পড়ার–টেবিল, সঙ্গে কাঠের সিংহাসন। সে পার্কে খেলতে গেলে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল ঘুরাতে পছন্দ করতো, তাই সেটাও বানালাম। নার্সারি রাইম্স্ wheels on the bus goes… তার পছন্দের; সেজন্য বাস বানালাম। শুধু বাস বানিয়েই দিলাম তা নয়, তাকে শিখানোর জন্য বাসের বডিতে নানান শেইপ দিলাম– ট্রায়াঙ্গেল, স্কোয়ার, রেক্ট্যাঙ্গেল। বাসার পিছনের মাঠে খেলার জন্য বানালাম কাঠের backyard-bridge, see-saw (teeter-totter)। বৈকালিক চা–নাস্তার জন্য, বাসার সঙ্গে একটা লাগানো ডেক বা কাঠের পাটাতন ছিলো। সেটার কাঠ এই বিশ বছরে নরম হয়ে এসেছিলো, তাই সেটা বদলে ফেললাম। পুরানো কাঠ থেকে বেছে বেছে ভালোগুলো দিয়ে একটা বড়সড় tree-house (playground clubhouse) বানালাম। দুইটা vegetable box নড়ী বানালাম সব্জীচাষের জন্য। একটা backyard-bench বানালাম উঠানের firepit–এর পাশে বসার জন্য। ২০২০ সালে ওহাইহো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারন্যাশানাল ছাত্রদের বার্ষিক কম্পিটিশানে শহীদ–মিনার বানিয়ে বাংলাদেশীদের চ্যাম্পিয়ান হতে সাহায্য করলাম।
এত্তো টাকা খরচ করে, এত্তো সময় নষ্ট করে কেন করি কাঠের কাজগুলো? এর উত্তর একটা নয়, অনেকগুলোই। কী যে আনন্দ পাই, তা নিজে না করলে বুঝতে পারবেন না। কিছু একটা সৃষ্টি করার তৃপ্তি, এক ধরনের ভাললাগা। দৈনন্দিন জীবনে দুনিয়ার সব স্ট্রেস–টেনশান–দুশ্চিন্তা ভুলে যাওয়ার এক উপায় হলো নিজেকে এমনকিছুর মাঝে ডুবিয়ে ফেলা, যার থেকে আপনি নিজে অপরিসীম আনন্দ পাবেন। লেখালেখির ঝোঁক ছিলো বরাবরই, সেই সঙ্গে আছে দেশ–বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর নেশা, নতুন কিছু করার নেশা। এখন স্ট্রেস–রিলিভার হিসাবে কাঠেরকাজটাও নতুন যোগ হয়েছে, বিশেষ করে ২০২০ সালের করোনাকালীন সময়ে হাতে অনেক সময় বেঁচে যায়; আর আমিও ঘুরাঘুরি কমিয়ে বাসাতেই কাঠের কাজ করে সময় কাটাই। আর সবকিছুর শেষে, আপনার বানানো জিনিস যখন অন্যের প্রশংসা কুড়ায়, বা যাকে উপহার দিলেন, সে যদি অকৃত্রিম ও আন্তরিকভবে খুশী হয়, তার থেকে বড় পাওনা আর কিছুই নাই।
টলিডো, ওহাইও, ২০২২
refayet@yahoo.com