ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৪শ আসন জয়ের স্বপ্ন দেখলেও তা পূরণ হয়নি। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনী ফলের বিপরীতে এবার মোদির দল বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাজিক ফিগার ছুঁতে পারেনি। মোদি ম্যাজিকে কাজ দেয়নি। বিপরীতে উঠে এসেছে রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস।
ভোট গণনার রাতে গতকাল বিজেপি সদরদপ্তরে ভাষণে মোদি বলেন, হৃদয় থেকে আজ আমি খুব, খুব খুশি। এরপর ভারতের গণতন্ত্রকে বিশ্বাসযোগ্যতার উদাহরণ বলে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, বিজয়ের এ মুহূর্তে আমি দেশের প্রত্যেক ভোটারকে বলব, আমি তাদের মাথা নত করে সালাম জানাতে চাই। আর রাহুল গান্ধী গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশের মানুষ মোদি এবং বিজেপিকে শাস্তি দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছে। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
লোকসভা নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হলো বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) এবং বিরোধী ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (ইন্ডিয়া)। ভোট শেষ, ফল প্রকাশও হয়ে গেছে। এখন পালা সরকার গঠনের। তবে সরকার গঠন করবে কে? এনডিএ নাকি ইন্ডিয়া? এই নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে বিশ্লেষণ। এবার মমতার দুর্গে হানা দিতে পারেনি বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ২৯, বিজেপি ১২ ও কংগ্রেস একটি আসন পেয়েছে। অপরদিকে ৫৪৩ আসনে বিজেপি এককভাবে পেয়েছে ২৪০ আসন, কংগ্রেস ৯৯ এবং অন্যরা পেয়েছে ২০৪ আসন। সব মিলিয়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ পেয়েছে ২৯৪ আসন। তাদের প্রতিপক্ষ ইন্ডিয়া পেয়েছে ২৩২ আসন। অন্যরা পেয়েছে ১৭ আসন।
এবার আর সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না বিজেপি। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে কেন্দ্রে সরকার গড়ার জন্য মোদিকে নির্ভর করতে হবে জোট এনডিএর দুই শরিক চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) এবং নীতীশ কুমারের জেডিইউর ওপর। নীতীশের নেতৃত্বাধীন জনতা দল (ইউনাইটেড) ১৪টি আসন পাবে এবং নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) ১৬ আসন পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অতীতে এ দুই দলের নেতারই একাধিকবার এনডিএ ত্যাগ এবং ফিরে আসার ইতিহাস রয়েছে। এবার তারা কী করেন সেদিকেই নজর সবার।
সমর্থন ছাড়া বিজেপির পক্ষে কেন্দ্রে সরকার গড়া সম্ভব নয়। আর এতেই দুই নেতার রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে গেছে। আর তারা সত্যিই শেষ পর্যন্ত বিজেপিকে সমর্থন করেন নাকি আবারও ভোল পাল্টান তা নিয়ে জল্পনা বাড়ছে।
রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) বলছে, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং টিডিপির চন্দ্রবাবু নাইডু এবার মোদির এনডিএ জোটকে বাদ দিয়ে বিরোধীপক্ষের সঙ্গে যোগ দিতে পারে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে জেডিইউ ও টিডিপি দুটি দলই বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের অংশ হিসেবে ভোটে লড়লেও নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর এ দুই দল যে বিজেপিকে সমর্থন করতে বাধ্য থাকবে তা নয়। কিন্তু সরকার গড়ার চাবিকাঠি যে চন্দ্রবাবু নাইডু ও নীতিশ কুমারের হাতেই থাকছে সেটি সন্দেহাতীত।
ওদিকে ভারতের ইতিহাসে মোদিই যদিও আবার প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন, যিনি পর পর তিনবার ক্ষমতায় আসছেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে জওহরলাল নেহরুর মতো পরপর তিন বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতা দখলের রেকর্ড আর গড়তে পারছেন না মোদি।
আজ শরিক দলগুলো সঙ্গে এনডিএ জোট বৈঠকে বসতে চলেছে বলে জানিয়েছে এনডিটিভি। ইতিমধ্যে টিডিপি নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তথা জেডি (ইউ) নেতা নীতিশ কুমারের সঙ্গে খোদ অমিত শাহ কথা বলেছেন।
বসে নেই ইন্ডিয়া জোটও। ইন্ডিয়া জোট ২০০–র বেশি আসনে এগোনোর পর থেকেই ঘর গোছাতে শুরু করে দিয়েছে কংগ্রেস শিবির। এই জোট গড়ার শুরুতে নীতীশ কুমার প্রধান ভূমিকা নিলেও পরবর্তীতে দলবদল করে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তবে সেকথা ভুলে নীতীশ কুমারের সঙ্গে কথা বলেছে কংগ্রেস। তাছাড়া জোট শরিক না হলেও সরকার গঠনে বড় ফ্যাক্টর হতে চলা চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গেও কথা বলেছে কংগ্রেস।
টানা তৃতীয় জয়েও বড় ধাক্কা : ভারতের লোকসভা নির্বাচনে এবার ৪০০ আসন জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচনী প্রচার থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত ‘আবকি বার ৪০০ পার’ স্লোগান তুলেছিল মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শিবির। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মোদি টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসতে চললেও ভোটের অপ্রত্যাশিত খারাপ ফলে বিস্ময়কর ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি।
মোদির টার্গেট ছিল বিজেপির ৩৭০ আসন। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলল। ৪০০ তো দূর, ৩০০–র গণ্ডিও পেরোল না বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএর আসনসংখ্যা। এমনকি ২০১৯ সাল থেকেও ফল খারাপ হয়েছে মোদি শিবিরের। ওই বছরের নির্বাচনে বিজেপি একাই ৩০৩ আসনে জয়ী হয়েছিল।
আর এবারের ভোটের সর্বশেষ ফলে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বিজেপি এগিয়ে আছে ২৪০ আসনে। কংগ্রেস এককভাবে এগিয়ে আছে ৯৯ আসনে।
এক দশকের মধ্যে এই প্রথম মোদির দল বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাচ্ছে। তারা লোকসভায় এককসংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্যপ্রয়োজনীয় ২৭২ আসন পাচ্ছে না। অথাৎ কেন্দ্রে সরকার গড়তে দলটিকে এখন এনডিএ শরিক ছোট দলগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে। ওদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের বিস্ময়কর ভালো ফলাফলও বিজেপি শিবিরের বিপুল বিজয়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করেছে।
অনেক নির্বাচন পর্যবেক্ষকই বিরোধী জোট ইন্ডিয়াকে শক্তিশালী অবস্থানে উঠে আসতে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বেশ কয়েকটি রাজ্যের ভোটে ইন্ডিয়া জোটের হিসাব পাল্টে গেছে। দিল্লিতে কংগ্রেস সদর দপ্তরের বাইরে এরই মধ্যে উল্লাস শুরু করেছে কংগ্রেস।
বিরোধী শিবিরের ভালো ফলে অনেকটাই বিপাকে পড়েছে বিজেপি। এ রকম পরিস্থিতিতে ইন্ডিয়া জোট সরকার গঠন করতে পারবে কিনা সে প্রশ্নও সামনে আসছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এরই মধ্যে বিজেপির ভোটের ফল নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। গতকাল সাংবাদিকদেরকে তিনি বলেছেন, দেশের মানুষ মোদি এবং বিজেপিকে শাস্তি দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছে।
অনেকেই ভারতের এবারের লোকসভা নির্বাচনকে মোদির কয়েক দশকের প্রধানমন্ত্রীত্বের ওপর গণভোট হিসাবেই দেখেছেন। যে প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে মোদি ভারতে জনজীবনের বিভিন্ন বিষয়ে রূপান্তর ঘটিয়েছেন। সেদিক থেকে এবারের ভোটের ফলে গোটা ভারতজুড়েই বিজেপি বিষণ্ন।
বিজেপি সদরদপ্তরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও কোনও জৌলুস দেখা যাচ্ছে না। মোদি–মোদি স্লোগানে মুখরিত হলেও লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার ব্যর্থতা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপির জয় উদযাপন অনুষ্ঠানে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেবল একটি ছোট পোস্ট করে জনতাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে সাতটি ধাপে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেখা গেছে অনেক নতুন ধারাও। নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। মোট ৯৭ কোটি নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছে ৬৪ কোটি ২০ লাখের মতো ভোটার।
মোদির নিরঙ্কুশ জয় সহজসাধ্য না হওয়ার আশঙ্কা বাস্তব হওয়ার পেছনে কাজ করেছে কিছু কারণ। বেকারত্ব, ক্রয়ক্ষমতা হারানো ও ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে টান পড়ার মুখে ভোটাররা বিজেপি বিমুখ হয়েছে। আবার ব্যক্তি মোদির জনপ্রিয়তায় ভাটা না পড়লেও তার দলের প্রার্থীরা অতটা জনপ্রিয় ছিলেন না। বিজেপির প্রার্থীদেরকে ভোটাররা সরাসরি অবজ্ঞা না করলেও তারা ভোটারদের এক ধরনের ঔদাসীন্নের মুখে পড়েছিলেন।
ওদিকে মোদির মুসলিমবিরোধী অবস্থান এবং সরাসরি আক্রমণ করে কথা বলাও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে ভোটে। কংগ্রেস পার্টিকে মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে তিনি সমালোচনা করেছিলেন। তার উসকানি দেওয়া বক্তৃতা তার পদ–পদবির জন্য অবমাননাকর হয়েছে। বিরোধীদলগুলোও মোদির আমলের বেকারত্ব, জীবনযাত্রা ব্যয় বৃদ্ধি থেকে শুরু করে সবকিছুই জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। দেশকে একনায়কতন্ত্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে ঠেকানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে তারা।
ওদিকে, ভোটের আগে দিয়ে বিজেপি বিরোধীদের ওপর দমন–পীড়ন বাড়ানোও ভোটে তাদের খারাপ ফলের পেছনে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে। বহু বিরোধীদলীয় নেতা এবং সরকারের সমালোচক সাম্প্রতিক সময়ে জেলে গেছেন। এর মধ্যে আছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও। যাকে গত এপ্রিলে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে কাস্টডিতে নেওয়া হয়। পরে অন্তর্বর্তী জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিলেন।
এতসব কিছুর প্রেক্ষাপটে এবারের নির্বাচনে ভোটারদের মোহগ্রস্ত করার মতো কিছু বিজেপির ছিল না। বরং জনগণের সামনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের যথেষ্ট নজির আছে। অন্যদিকে, বিরোধীরা নতুন আত্মবিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়েছে। সে কারণেই আগেরবারের মতো ফল বিজেপি এবার করতে পারেনি। এসেছে পরিবর্তন।
উত্তর ও দক্ষিণে জোড়া জয়ে নজির গড়লেন রাহুল : নির্বাচনে উত্তর থেকে দক্ষিণ, রায়বরেলি থেকে ওয়েনাড় একসঙ্গে দুটি কেন্দ্র থেকেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে নজির গড়েছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। উত্তর প্রদেশের রায়বরেলিতে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রার্থী দীনেশ প্রতাপ সিংকে পিছনে ফেলে প্রায় ৪ লাখ ভোটে জয়ী হয়েছেন তিনি। আর তার নিজের কেন্দ্র দক্ষিণের রাজ্য কেরালার ওয়েনাড়েও ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৪২২ ভোটে জয়ী হয়েছেন রাহুল। এটি নিছক নির্বাচনী জয় নয়, রাহুল ও তার দলের সম্মানের জয় বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। তাই রাহুল গান্ধীকে বিপুল জয়ের জন্য শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।