ভেতরে ভেতরে অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হলেও কোনো ব্যাংক যাতে শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া না হয়, সেগুলো যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে বলে দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করলেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। ব্যাংক খাতে সংস্কারের প্রসঙ্গ টেনে গ্রাহকের আমানত রক্ষার পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথমে ১০টি ব্যাংক, এরপর ক্রমান্বয়ে সব ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা পরীক্ষা করা হবে। এরপর প্রয়োজনে মার্জ করা হবে। তবুও গ্রাহকের আমানত ঝুঁকিতে ফেলা হবে না।
আওয়ামী লীগ আমলে ঝিমিয়ে পড়া ব্যাংক খাত সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলছে, তার মধ্যেই বিভিন্ন ব্যাংকের দুর্বলতা বেরিয়ে আসছে, গ্রাহকদের মধ্যে উদ্বেগও রয়েছে। এসব পরিস্থিতিতে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংবাদ সম্মেলন ডেকে কথাগুলো বলেছেন গভর্নর আহসান মনসুর। খবর বিডিনিউজের।
গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করা হয়নি। কেউ অনিয়ম করলেও তার প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব চালু রাখা হয়েছে। যাতে ব্যবসা–বাণিজ্য স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে। এ বিষয়ে সুযোগ সন্ধানীরা নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে।
ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠনের কাজ অনেকটাই এগিয়ে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, আগামী ১০ দিনের মধ্যেই কাজ শুরু করতে পারব। ব্যাংকগুলোর ফরেন্সিক প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করবে এডিবি। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য যাচাই করে সে আলোকে কাজ করবে টাস্কাফোর্স। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর লেনদেন দৈনিক ভিত্তিতে যাচাই করা হচ্ছে; রেগুলার ক্যাশফ্লো মনিটরিং করা হচ্ছে।
ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৫ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু বিতরণ হচ্ছে না। তার মানে পদ্ধতিগত ক্রটি আছে। কঠিন শর্ত দিয়ে ঋণ বিতরণ হবে না। নমনীয় নীতি দরকার। আমরা চেষ্টা করব যাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঋণ পায়। এ খাতে এডিবি অর্থ সহায়তা করতে আগ্রহী।
এক প্রশ্নে আহসান মনসুর বলেন, প্রভাবশালীদের জন্য যেসব পলিসি করা হয়েছে, তা রিভিউ করা হবে। রিভিউ করার পর যদি দেখা যায় ১০ বা ২০ জন লোকের জন্য করা হয়েছে; তাহলে তা বাতিল করা হবে। ব্যাংক খাতের পরিবারতন্ত্র রুখতে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। তবে তা এখনই করা হচ্ছে না। শেষ দিকে করা হবে। কারণ আইন বারবার পরিবর্তন করা যায় না।
ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক খাতের বাইরে ছিল। তাই সংকট দেখা দিয়েছিল। বর্তমানে ৩০ হাজার কোটি টাকা ফেরত এসেছে। তাই পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ফলে টাকা উত্তোলনের যে সীমা ছিল, তা তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে যে ১০ ব্যাংকের সমস্যা রয়েছে; তাদের গ্রাহকদের আরও কিছু দিন ধৈর্য ধরতে হবে।
এঙ্মি ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে গভর্নর বলেন, এটা আগের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। তাই দেওয়া হয়েছে। এখন আর এভাবে তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না। তবে ব্যাংকগুলো যাতে তারল্য সহায়তা পায়, সেজন্য আন্তঃব্যাংক থেকে ধার করার সুযোগ করে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে ওইসব ব্যাংকের গ্যারান্টার হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এস আলম গ্রুপের সম্পদ সংক্রান্ত এক প্রশ্নে গভর্নর বলেন, যারা এসব সম্পদ কিনবে তারা যেন নিজ দায়িত্বে কেনেন। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক দায়–দায়িত্ব নেবে না।
এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যাংক খাত অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল অংকের টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ রয়েছে; যা নিয়ে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ও দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ করছে।
৯৫ শতাংশ অ্যাকাউন্ট নিরাপদ : সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতকারীর ৯৫ শতাংশের একাউন্ট নিরাপদ রয়েছে বলে দাবি করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৫ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার ২২৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ বা তার নিচে অর্থ আছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১৪ কোটি ৭১ লাখ ৩৩ হাজার ৭৩৩টি। অর্থাৎ আমানতবিমা বৃদ্ধির কারণে ৯৫ শতাংশ আমানতকারী নিরাপত্তা পেয়েছে।
আহসান মনসুর বলেন, আমানতবিমা দ্বিগুণ করার কারণে ব্যাংক খাতের মোট আমানতকারীর ৯৫ শতাংশ অ্যাকাউন্ট নিরাপদ আছে। আমানতের বিপরীতে যে বিমা রাখতে হয়, তা আগে ছিল ১ লাখ; সেটা এখন থেকে দুই লাখ টাকা করা হয়েছে।
দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে জনমনে যাতে শঙ্কা তৈরি না হয়, সে বিষয়ে গভর্নর বলেন, আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স দ্বিগুণ করা হয়েছে। আগে এটি ছিল ১ লাখ, এখন ২ লাখ করা হয়েছে। এখন থেকে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হলে আমানতকারী ২ লাখ টাকা পাবেন। এর ফলে ৯৫ শতাংশ আমানতকারীর অ্যাকাউন্ট নিরাপদ হলো। এর বেশি নিরাপত্তা কোনো দেশেই দেওয়া হয় না। কোনো প্রকার প্রিমিয়াম না বাড়িয়েই এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। প্রিমিয়াম আগের মতোই দশমিক শূন্য ৮ শতাংশই আছে।