কাক কোকিলের ঠোঁট মা

সালাম সৌরভ | বুধবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীতে একই জাতের প্রাণী কয়েক রকম, কয়েক ধরন, যেমন আছে, তেমনি আবার একই রকম দেখতে, কয়েক জাতের প্রাণী রয়েছে। যেমন বানর, হনুমান, শিবপাঞ্জি, দেখতে একই রকম কিন্তু জাত আলাদা। বিড়াল, বাঘ,-সিংহ, দেখতে একই রকম, কিন্তু জাত আলাদা। আবার চিতা, রয়েল, নেকড়ে, বাঘ একই, কিন্তু শারীরিক গঠন প্রণালী, স্বভাব আলাদা। ফুল, পাখি, মাছ, জানোয়ার, প্রতিটি ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায়।
আজকে আমরা গল্প শুনবো কাকের এবং কাকের পালিত সন্তান কোকিলের কথা কাক এবং কোকিলের শারীরিক গঠন প্রণালী দেখতে একই রকম এবং দুটি পাখির গায়ের রঙ কালো। কোকিল একটু বেশি কালো। পাতিকাকের ঘাড়ের দিক দিয়ে একটু ছাই রঙ। ঠোঁটের ধরন একই রকম। ছোটবেলায় দেখে বোঝার কোন উপায় নেই, কে কাক ? কে কোকিল?
কাক এবং কোকিল দুটো পাখির ডিম দেখতে প্রায় একই রকম, সাইজ ও একই সমান। কাক তো চালাক প্রাণী, তার চেয়ে একটু বেশি চালাক কোকিল। না হয় তার ডিম কি পরের ঘরে অর্থাৎ কাকের ঘরে ফুটতো? বাচ্চারা কি আর পরের ঘরে মানুষ হতো ? গল্পটা খুবই চমৎকার এবং মজাদার।
আনাস দের বাড়ির পাশে একটা বাদাম গাছ, দুটো কাক বাড়ির ছাদে কিংবা বাদাম গাছের এসে রোজ সকালে কা কা করে ডাকতো। আনাসের ঘুম ভাঙাতো। আনাস ঘুম থেকে জেগে বেলকুনিতে ব্রাশ করতে করতে এসে আগে কাক দুটোকে দেখতো, তারপর হাত মুখ পরিষ্কার করে, নাস্তার টেবিলে নাস্তা সারার পর, প্রতিদিন পরোটা রুটি অর্ধেক রেখে দিত।
মা বলতো-আনাস নাস্তা অর্ধেক রেখে দিলে কেন ?
-মা ওইটুকু নাস্তা কাক দুটোকে খাওয়াবো।
-তোমারটা তুমি খেয়ে নাও বাবা, কাককের জন্য আমি বাসি রুটি রেখেছি।
আনাস অর্ধেক নাস্তাটা ছাদে নিয়ে গিয়ে কাক দুটোকে খাওয়াতো। একদিন সকাল বেলা আনাস ছাদে উঠে চিৎকার শুরু করল,- দাদু দাদু এসে দেখে যাও, বাদাম গাছে কাক দুটো কি সুন্দর বাসা বানিয়েছে,
এই পাঁচ বছর বয়সে আনাসের এই প্রথম কোন পাখির বাসা দেখা। তাই এতো উৎসাহে চেচামিচি চিৎকার। শহরে কাকের বাসা ছাড়া আর কি আছে? নানান জাতের পাখি থাকলেও বাসা বাঁধার মতো উপযুক্ত স্থান তারা পায় না।
দাদু তাড়াহুড়া করে ছাদে উঠে বলল,
-কিরে আনাস চিৎকার করছিলে কেন?
-দাদু বাদাম গাছের দিকে একটু তাকাও কি সুন্দর কাক গুলো বাসা তৈরি করেছে।
-কই দেখি তো ! তাইতো। শুনো আনাস কাকের ডিম পাড়ার সময় হলে বাসা বাঁধে। না হয় এমনিতে ওরা গাছের ডালে ডালে রাত কাটিয়ে দেয়। ডিম পাড়ার সময় হয়ে এসেছে, সেই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটাবে।
মানুষের মতো পৃথিবীর সব প্রাণী বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে।
-দাদু কাক দুটোকে আমি রোজ রুটি খেতে দেয়। কারণ ওরা আমাকে রোজ ভোর বেলায় ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ে।
-আচ্ছা তাই নাকি? কিন্তু এইখানে কাকের জন্য একটা বিপদ ও দেখতে পাচ্ছি।
-কি বিপদ দেখতে পাচ্ছ দাদু?
-ওই দেখো ,ওই পাশের ছাদে দুটো পাখি, কাকের মত দেখতে, ওরা হচ্ছে কোকিল। কন্ঠ ডাক মিল নেই ,কাক ডাকে কা কা, আর কোকিল ডাকে কুহু কুহু।
-দাদু বিপদের কথা কি যেন বলছিলে?
-শুনো, কোকিল গুলো চুপি চুপি কাকের বাসা দেখতে এসেছে, আর দেখতে এসেছে কাক কবে ডিম পাড়ে?
-কেন দাদু বলতো?
-তবে শোনো মজার ব্যাপারটা, কাক ডিম পাড়ার পর, কোকিল কাকের বাসার আশেপাশে লুকিয়ে থাকে। কাক আর কাকি দুজন যখন খাবারের খোঁজে বাইরে থাকে, তখন কোকিল চুপিচুপি কাকের বাসায় ঢুকে কাকের ডিম গুলো ঠোঁট আর পা দিয়ে ভেঙে ফেলে। নয়তো মাটিতে নিচে ফেলে দেয়ে। আর নিজেই ওই জায়গায় ডিম পেড়ে বসে। কাক ফিরে এসে বাসায় নিজের ডিম ভেবে তা দিতে থাকে। একদিন বাঁচাও ফুটে। মা কাকটা বাহির থেকে খাবার নিয়ে এসে বাচ্চাগুলোকে ঠোঁটে ঠোঁটে খাওয়াতে থাকে । সেজন্য তো কাক কে কোকিলের ঠোঁট মা বলা হয়। বাচ্চাগুলো যখন উড়ন্ত হয় তখন তাদের কন্ঠ পরিবর্তন আসে। তখনই বিপদ, কোকিলের বাচ্চা বাড়ি ছাড়ার। কাক টের পেয়ে বাচ্চাগুলোকে আর সহ্য করে না । বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ততদিনে কোকিলের বাচ্চাগুলো উড়াল শিখে ফেলে। তাই ওরা উড়াল দিয়ে তাদের নিজেদের ঠিকানায় চলে যায় । এই হচ্ছে কোকিলের জন্ম কাহিনী।
দাদুর মুখে কাক ও কোকিলের কাহিনী শুনে আনারসের কৌতূহলের শেষ নেই। সে প্রতিদিন সকাল-বিকেল দুবার ছাদে উঠে কাকের বাসা টাকে দেখতে যায়। আর নিজে না খেয়ে রুটি বিস্কুট কাকদের খাওয়াতে দেয়। দেখতে দেখতে কাকের বাসা টা অনেক বড় হয়ে উঠলো।
দাদু বলেছে ওরা খড়, খুড়ো তার, দড়ি যা পায় তা দিয়ে ঘর তৈরি করে। দুই সপ্তাহ পর আনাস আবার ছাদে গিয়ে চিৎকার শুরু করলো।
-দাদু দাদু দেখে যাও কাকে ডিম পেড়েছে, ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছে।
-কি ব্যাপার আনাস এত চিৎকার চেঁচামেচি করছ কেন?
-ওই দেখো না দাদু ,ওগুলো কাকের ডিম না?
-তাই তো দেখছি, ডিম পেড়েছে তাহলে!
-দাদু ওদের বাসার উপর তো কোন ছাউনি নেই , বৃষ্টি পড়লে ডিম গুলো নষ্ট হয়ে যাবে না?
-নারে ওরা ডিমগুলোকে খুব যত্ন করে তা দেয় বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখে, মা কাক খাবার বা পানি খেতে গেলে, বাবা কাক “তা” দিয়ে রাখে।
-দাদু কাকেরা এত পাহারা দেওয়ার পরও, কোকিল কিভাবে ওদের বাসায় ডিম পাড়ে?
-কিভাবে কাকের বাসায় কোকিল ডিম পাড়ে সেই বুদ্ধির কাহিনী বলছি শোনো।
বাবা কাকটা খুব রাগী, কোকিল দেখলে ওর মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। কোকিল কে তারা করে। মা কাকটা বাবা কাক কে বাসায় রেখে খাবার কিংবা পানির তৃষ্ণা মিটাতে দূরে কোথাও গেলে, তখনই অঘটনটা ঘটে যায়।
বাবা কোকিল কাকের বাসায় সামনে এসে ঘোরাঘুরি করতে থাকে, মা কোকিলটা দূরে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। কোকিলের ঘোরাঘুরি দেখে, বাবা কাকটা রাগে ডিমগুলো ফেলে বাসা থেকে বের হয়ে বাবা কোকিল টাকে তাড়া করেতে থাকে। বাবা কোকিলটা যখন কাকটাকে ব্যস্ত রাখে, ঠিক সেসয় মা কোকিলটা কাকের বাসায় ঢুকে কাকের ডিমগুলোকে ফেলে দিয়ে, নিজে ডিম পেরে দ্রুত চলে আসে । এজন্য বলি কাক থেকে কোকিল একটু বেশি চালাক।
একদিন গুটিগুটি টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল, আনাস ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কাকের বাসা দেখছে। বাসায় ডিম দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু কাকদের কোন দেখা নেই। আনাস দেখল কিছুক্ষণ পর পর একটা একটা করে ঠোঁটের করে খড় নিয়ে আসছে, বাসায় রেখে আবার চলে যাচ্ছে । এবার দেখল মা কাক টা বিদ্যুতের খুঁটিতে বসে, বিদ্যুতের তারে নিয়ে টানা হেচরা করছে।
আনাস কবে থেকে খাবার নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ কাক টার ওর দিকে কোন খেয়াল নেই, সে এক মনে বিদ্যুৎ খুঁটির তার ছিঁড়তে ব্যস্ত। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ খুঁটিতে একটা বিকট শব্দ হল। সাথে সাথেই বিদ্যুৎ চলে গেল, কাক টা শট খেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ল।
আনাস ব্যালকনি থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখতে পেল। মা কাকটি উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে রইলো।
-দাদু দাদু একটা কারেন্টে শট খেয়েছে ।
দাদু দৌড়ে এসে দেখল, কাকটা উপড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছে।
-চলো দাদুভাই ,আমরা নিচে গিয়ে দেখি, কাক টা বেঁচে আছে কি না?
দাদু আর আনাস দুজনে নিচে গিয়ে দেখল কাক টা আর বেঁচে নেই। সেদিনের পর থেকে বাবা কাক টাকে আনাস আর কখনো বাসায় ফিরতে দেখেনি। শুধু ডিম দুটোই পড়ে রইল শূন্য খাঁচায়।
দুদিন পর আনাস এর মাথায় একটা চিন্তা এলো, দাদুকে দেখে বলল।
-আচ্ছা দাদু ,আম্মু তো আমাদের মুরগীটাকে ডিমে তা দিতে বসিয়েছে। কাকের ডিমগুলো মুরগির ডিমের সাথে মুরগিকে “তা” দিতে দিলে কেমন হয়?
-বৌমা আনাস কথাটা একেবারে মন্দ বলে নি । ওই কথা তো কখনো আমাদের মাথায় আসেনি।
আনাসের বাইনা ও আবদার
-প্লিজ দাদু ! কাকের ডিম গুলো নামিয়ে দাও না।
আনাসের পীড়াপীড়িতে দাদু পাশের বাড়ির দারোয়ান কে দিয়ে ডিম দুটো কাকের বাসা থেকে নামিয়ে আনলো।
আনাসের কথামতো কাকের ডিম গুলো মুরগিকে দিয়ে তা দেওয়া হল। প্রায় একুশ
দিন পর মুরগির ডিম গুলো বাচ্চা ফুটালো। কিন্তু কাকের ডিমগুলো মুরগি টা ছুঁয়ে ও দেখল না। আনাসের খুব মন খারাপ হলো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকি ছু জা না কি ছু অ জা না
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবর্তক সংঘ এলামনাই এসোসিয়েশনের সভা