মৌসুমি ফল উৎপাদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের সুখ্যাতি দীর্ঘদিনের। দেশে উৎপাদিত মৌসুমি ফলের প্রায় এক দশমাংশ উৎপাদন হয় তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে। বিশেষত পাহাড়ের গ্রীষ্মকালীন ফল আম, কাঁঠাল, আনারস ও বারোমাসি কলার কদর বেশি। দেশজুড়ে চাহিদা থাকলেও বিভিন্ন সময়ে ন্যায্য বাজার মূল্যের অভাব ও ফল বাজারজাতকরণে প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রায় প্রতি মৌসুমেই নষ্ট হচ্ছে পাহাড়ে উৎপাদিত ফলের একটি অংশ। পাহাড়ের ফল পচন রোধ ও নষ্ট করে না সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বছরজুড়ে অর্থনৈতিক চাকা সচলের উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়েছে কাঁঠাল ও কলার চিপস উৎপাদন। প্রান্তিক পর্যায়ের চাষিদের কাছে ন্যায্যমূল্যে কাঁচামাল হিসেবে কাঁঠাল ও কলা কিনে সেগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে চিপস উৎপাদনের কারখানা তৈরি করেছেন রাঙামাটির তিন উদ্যোক্তা। চলতি বছরের মে মাসে ‘হিলস্ বাজার’ নামের কারখানাটি চালুর পর এখন প্রাথমিকভাবে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে এসব চিপস। এ কাজে সহযোগিতা করছে ‘বৈচিত্র্য ডটকম’ নামের পাহাড়ের একটি ই–কমার্স ওয়েবসাইট।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০২৪ সালের মে মাসে রাঙামাটি জেলা শহরের আসামবস্তি এলাকায় তিন তরুণ উদ্যোক্তা সুবিমল চাকমা, প্রমথ চাকমা ও শান্তু চাকমা ছোট পরিসরে একটি চিপস তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছেন। কারখানাটির কার্যক্রম শুরু করতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কারিগরি সহয়তা ও ডাচ্ বাংলা ব্যাংক পিএলসি আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছে। শুরুটা কাঁঠাল ও কলার চিপস তৈরির মাধ্যমে কারখানাটি সচল করলেও ভবিষ্যতে অন্যান্য ফলের চিপস উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে উদ্যোক্তাদের।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ থেকে ‘স্বল্পমূল্যের ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং মেশিনের মাধ্যমে আলু, কলা, আম ও কাঁঠালের গুণগত মান বজায় রেখে উৎকৃষ্ট মানের চিপস তৈরির প্রযুক্তি ও কলাকৌশল’ সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন রাঙামাটির তিন উদ্যোক্তা সুবিমল চাকমা, প্রমথ চাকমা ও শান্তু চাকমা। চলতি বছরের মে মাসে ছোট পরিসরে প্রায় ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে কারখানা গড়ে ভ্যাকুয়াম মেশিনের সাহায্যে কলা ও কাঁঠালের চিপস উৎপাদন করছেন। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় দোকানপাট, বাজার ও বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে চিপস সরবরাহ করছেন। এছাড়া বিভিন্ন ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান, ফোরামের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিপণন করছেন। ২৫ গ্রাম ওজনের প্রতিটি চিপসের বাজারে খুচরা মূল্য ৩০ টাকা। সম্প্রতি চিপস প্রস্তুতকারক কারখানায় গিয়ে সরেজমিন দেখা গেছে, তিন উদ্যোক্তার একজন প্রমথ চাকমাসহ কয়েকজন সহযোগী ভ্যাকুয়াম মেশিনের মাধ্যমে কাঁঠাল ও কলা প্রক্রিয়াজাত করে চিপস তৈরি করছেন। প্রথমে কাঁচামাল হিসেবে কলা ও কাঁঠালকে তেলে মেশিনের মাধ্যমে তেলে ভাজার পর সেগুলো আবার মেশিনের মাধ্যমে শুকিয়ে তেল শুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এরপর চিপসগুলোতে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় মশলা মিশিয়ে প্যাকেটিং করে বায়ু ভর্তি করে বাজারের সরবরাহের উপযোগী করা হয়।
বৈচিত্র্য ডটকম ই–কমার্স সাইটের প্রতিষ্ঠাতা পল্লব চাকমা বলেন, আমরা তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উৎপাদিত চিপসগুলো সারাদেশে বিতরণ, বিপণন ও প্রচার করছি অনলাইনের মাধ্যমে। তাদের চিপসগুলো নিয়ে অনলাইনে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।
আরেক প্রতিষ্ঠাতা সাজিদ বিন মিকি বলেন, পাহাড়ে উৎপাদিত বিভিন্ন ফল ও পণ্য অনলাইনে ই–কমার্স সাইটের মাধ্যমে আমরা দেশজুড়ে সরবরাহ করে থাকি। পাহাড়ে উৎপাদিত কাঁঠাল ও কলার চিপসের চাহিদা বাড়ছে।
হিলস্ বাজার কারাখানার উদ্যোক্তাদের সহযোগী দীপ্ত দে বলেন, রাঙামাটি জেলা শহরের বিভিন্ন মেলা, অনুষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী আমরা চিপস তৈরি করে থাকি। এছাড়া প্রতিদিন প্রায় ২০০–২৫০ প্যাকেটের গ্রাহকদের মাঝে বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে উৎপাদন করা হয়ে থাকে।
হিলস্ বাজার কারখানার উদ্যোক্তা প্রমথ চাকমা বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে তৈরি চিপসের কাঁঠাল ও কলাগুলো স্থানীয় চাষিদের থেকে আমরা সংগ্রহ করে থাকি। আমরা দেখেছি পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক ফলমূল বিশেষ করে কলা, কাঁঠাল পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। চাষিরাও ক্ষতির মুখে পড়ে। সে কারণে আমরা এই ফলগুলো প্রক্রিয়াজাত করে চিপস তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা প্রথমে ক্ষুদ্র পরিসরে তিনজন বন্ধু মিলে এই উদ্যোগ নিয়েছি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (রাবি) থেকে আমাদের একটা চিপস তৈরি মেশিন দেওয়া হয়েছে এবং আমাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে ডাচ্ বাংলা ব্যাংক। স্বল্প পরিসরে আমরা এটি শুরু করলেও ধীরে ধীরে সাড়া পাচ্ছি। আপাতত এসব পণ্য এখানকার স্থানীয় বাজার, মেলা ও পর্যটন জায়গায়গুলোতে সরবরাহ করতে চাইছি। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠান বৃহৎ পরিসরে করা গেলে জেলার বাহিরেও বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাট্রিজের সভাপতি মো. আব্দুল ওয়াদুদ আজাদীকে বলেন, এমন উদ্যোক্তারা যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে আমরা তাদেরকে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে লোন পাওয়ার জন্য সহায়তাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকি।