সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে আসা একটা পাহাড়ি মেয়ের গান বারবার দৃষ্টি কাড়ছিল। “এটি কল্পনা চাকমার গান আমরা বাঙালিরা শুনিইনি নামটা তার, এই নামে ছিল বুঝি কেউ জিজ্ঞেস করো যদি কথা বলে উঠবে পাহাড়।” গণসংগীত শিল্পী সায়ানের গান। তাঁর কন্ঠেও শুনেছি গানটি। কিন্তু এই পাহাড়ি মেয়েটার শান্ত কন্ঠ হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছিলো!কত কষ্ট, কত বেদনার, কত দীর্ঘশ্বাসের ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। আমরা তার কতটুকু জানি! নিজ বাসভূমে পরবাসী হওয়ার যন্ত্রণা কেমন করে বুঝবে সমতলের মানুষেরা! আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি আরও তিন বছর আগে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের দামে কেনা স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ আজও হয়ে ওঠেনি। কেউ কথা রাখেনি। সরকারের পর সরকার বদল হয়েছে। কিন্তু সুশাসন আমরা দেখিনি। আমরা দেখিনি আইন তার নিজের গতিতে চলতে! সরকার না চাইলে ন্যায় বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। প্রমাণিত হয়েছে বারবার। সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে নাগরিকদের। পাহাড়ে যাদের বসবাস, যাদের আমরা পাহাড়ি বলি তাদের সাথেও হয়েছে অন্যায্যতা। এটা তো মানতে হবে। কল্পনা চাকমা অধিকারহীনতায় বেড়ে উঠতে উঠতে সোচ্চার হলো পাহাড়ি নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে, সোচ্চার হলো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে। হয়ে উঠে নারী অধিকারকর্মী, মানবাধিকার কর্মী ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯৯৬ সালে ১১ জুন জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগের রাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার লাইল্যঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়। তাঁর পরিবারের সামনে থেকে তাঁকে উঠিয়ে নেওয়া হলো। তাঁর ভাই অপহরণ মামলা করলো। দিন যায় রাত যায় সেই মামলা আটকে গেলো নানা ছুতোয়। ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় থেকে থেকে একদিন তার মা–ও দুনিয়া ছাড়লো। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় কল্পনা চাকমার অপহরণ মামলা চালানো গেলো না! একদা খারিজ হয়ে গেলো। জানতে পারলো না তার স্বজনেরা তাঁর সাথে কি হয়েছিলো! দেশবাসীরও জানা হলো না তাঁর পরিণতির কথা। বেশ কয়েকদিন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারও অশান্তি! আবারও আগুন জ্বলছে। সংঘাত হচ্ছে। প্রাণ ঝরছে। কেন ঝরছে তা আমরা জানি কিন্তু মূল জায়গায় আমরা যেতে চাই না। তারা তাদের ভূমি ফেরত চায়। তারা বাঙালি সেটেলারদের মতো স্বাধীনতা চায়। তাদের চলাফেরায় কোনো রকম হস্তক্ষেপ চায় না। তারা অসম্মানিত হতে চায় না। বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্য যে অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে তার অবসান হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত ভূমি সমস্যার সমাধান নাহলে এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড় কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছিলো। যদিও ২৫ বছর পরেও তা যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। কোনো সরকারই তা বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়নি। এলাকাগুলো সেনা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আছে দীর্ঘসময় ধরে। তাদের চলাফেরায় স্বাধীনতা না থাকলে তারা নিজেদের এদেশের নাগরিক ভাববে কিভাবে? মূল সমস্যাটা রাজনৈতিক। এই সমস্যাটা তো একদিনে তৈরি হয়নি। এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। বিগত সরকারগুলো সেখানকার সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি মোটেই গুরুত্ব দেয়নি। গত কয়েকদিন ধরে যে সহিংসতা, প্রাণহানি, সংঘাত ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে তা গভীর উদ্বেগের। দেশে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার জীবনধারা, মৌলিক মানবাধিকার ও ভাষা সংস্কৃতি বিষয়ে রাষ্ট্রের আরও সংবেদনশীল হওয়া জরুরি। আমাদের বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে এসেছেন। এখন সুযোগ এসেছে কাজ করার। সমস্যা ও অসন্তোষ জিইয়ে থাকায় পার্বত্য অঞ্চলে নানা সময়ে অস্থিরতা ও রক্তপাতের মতো ঘটনা বন্ধ হয়নি। প্রতিটি জীবনই মূল্যবান ও সম্ভাবনাময়। হিংসার উন্মত্ততায় আর কোনো প্রাণ যেন ঝরে না পড়ে। যেকোনো মূল্যেই পার্বত্য অঞ্চলে স্থিতিশীল পরিবেশ শান্তি ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই। সব পক্ষের দায়িত্বশীল আচরণ কামনা করছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড়ি অঞ্চলগুলো পর্যটকদের জন্য নিরাপদ হয়ে থাকুক। বৈষম্যবিরোধী সরকার অস্থির পাহাড়ে সাম্যের বারতা পৌঁছে দিক। পাহাড়ের মানুষগুলো বুঝতে পারুক সমতল আর পাহাড়ে কোনো বিভেদ নেই। আমরা সবাই বাংলাদেশী। এটাই আমাদের ঠিকানা। এটাই আমাদের দেশ। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, জীবনধারা ও ভাষার বৈচিত্র্যকে আমরা যেন সম্মান জানানোর যোগ্য হয়ে উঠি। ভালোবাসতে শিখি। কাউকে পিছনে ফেলে নয় হাতে হাত রেখে পাশাপাশি রেখে এগিয়ে যাওয়ার পথ যেন খুঁজে পাই।