কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৮০ ভাগ সাফল্যের দাবি

‘মশার উৎপাত থেকে মানুষকে খুব বেশি স্বস্তি দিতে পারিনি’

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৫ মে, ২০২১ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

নিজ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ সফল বলে বলে দাবি করেছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তবে মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ সফল হননি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘মশার উৎপাত থেকে মানুষকে খুব বেশি স্বস্তি দিতে পারিনি। এটার অবশ্য কারণও আছে। দায়িত্বগ্রহণের একশ দিন উপলক্ষে দৈনিক আজাদীকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন মেয়র। গতকাল দুপুরে টাইহগারপাসস্থ চসিকের অস্থায়ী কার্যালয়ে আলাপকালে তিনি একশ দিনের প্রতিশ্রুতি পূরণে সাফল্য-ব্যর্থতার পাশাপাশি নগরকে ঘিরে তার আগামী দিনের পরিকল্পনার কথাও জানান।
তিনি বলেন, চটগ্রামে সবকিছু আছে। যদি সেগুলো দিয়ে সাজানো যায় তাহলে আন্তর্জাতিক শহর হয়ে উঠবে। দরকার শুধু আন্তরিকতা। উদ্যোগ ও সৎ সাহস এবং কমিটমেন্ট থাকলে যে কোনো পরিকল্পনায় সাফল্য অর্জন সম্ভব। যেহেতু আমার লক্ষ্য আছে। আমি পারব। সে বিশ্বাস আমার আছে। দায়িত্ব পালনকালে আর্থিক সংকটকে বড় প্রতিবন্ধকতা উল্লেখ করে এর সমাধানে পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, গত ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন রেজাউল করিম চৌধুরী। ১১ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন তিনি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন ১৫ ফেব্রুয়ারি। আজ মঙ্গলবার মেয়রের দায়িত্বগ্রহণের শততম দিন।
দায়িত্বহগ্রহণকালে মেয়র মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ, ‘বিশৃক্সখল’ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শৃক্সখলা আনা এবং সড়ক সংস্কারের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন তিনি। এর আগে ২৩ জানুয়ারি ঘোষিত ৩৭ দফা নির্বাচনী ইশতেহারেও প্রথম ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনায় বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। একশ দিনের প্রতিশ্রুতি কতটুকু পূরণ করতে পেরেছন জানতে চাইলে মেয়র বলেন, সার্বিকভাবে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ। সবগুলো দৃশ্যমান। আমরা শতভাগ বলব না। সেটা সম্ভবও না।
মেয়র বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে সফল হয়েছি। বড় বড় খালগুলো সিডিএর মেগা প্রকল্পের অধীনে। তবু সেখানে আমরা কিছু পরিষ্কার করেছি। সিটি কর্পোরেশনের অধীনে যেসব ছোট-ছোট খাল, নালা-নর্দমা সেখানে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পরিষ্কার করেছি। সেটা চলমান। প্রতিদিন বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাজ হচ্ছে। সেগুলো দৃশ্যমান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজে মোটামুটি সফল।
রাস্তাঘাট : রাস্তাঘাট সংস্কারের প্রতিশ্রুতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, শহরের বিভিন্ন রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল না। ভাঙা ছিল। সেগুলো প্যাচওয়ার্কের মাধ্যমে সংস্কার করেছি। সবগুলো সড়ক গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত করেছি। এখন ভাঙাচোরা তেমন দেখা যায় না। সেখানেও ৭০ থেকে ৮০ ভাগ সফল।
উদাহারণ হিসেবে মেয়র স্ট্রান্ড রোড ও পোর্ট কানেকটিং রোডের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, স্ট্র্যান্ড রোডের করুণ অবস্থা ছিল। সেটারও ৮০ ভাগ কাজ শেষ করেছি। পোর্ট কানেকটিং রোড নিয়েও অনেক সমালোচনা হয়েছে। লেখালেখিও কম হয়নি। সড়কটির একপাশে কার্পেটিং ও ম্যাকাডম করে গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত করেছি। অতিরিক্ত টাকা নিয়ে সড়কটির ঠিকাদার কাজ ফেলে পালিয়েছে। ওই ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল করে কালো তালিকাভুক্ত ও জরিমানা করেছি। এখন নতুন করে টেন্ডার করেছি। সেটার প্রক্রিয়াও শেষের পথে। আশা করছি ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো সড়কের কাজ শেষ করতে পারব। মেয়র বলেন, মুরাদপুর-অক্সিজেন সড়কে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেখানে কাজ চলছে। সড়ক সংস্কারে প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরে মেয়র বলেন, কিছু সড়কে আমরা কাজ করলেও ওয়াসার পাইপ লিকেজ হয়ে রাস্তার ক্ষতি করছে। যেমন স্ট্র্যান্ড রোডে এ সমস্যা হয়েছে। পিসি রোডেও হয়েছিল।
মশক নিধন : মশক নিধনের প্রতিশ্রুতি পূরণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা ওষুধ ছিটিয়েছি। সব প্রক্রিয়া করেছি। কিন্তু আশানুরূপ নিয়ন্ত্রণ হয়নি। দুর্ভোগ থেকে মানুষকে খুব বেশি স্বস্তি দিতে পারিনি। এ বাস্তবতা আমাদের স্বীকার করতে হবে। তবে এর কারণ আছে। সিডিএ বড় বড় খাল-নালায় কাজ করতে গিয়ে বাঁধ দিয়েছে। এতে পানির প্রবাহ স্থবির হয়ে গেছে। স্থবির পানিতে স্বাভাবিকভাবে মশার প্রজনন ক্ষমতা বাড়বে। এটা বড় সমস্যা। এ বিষয়ে সিডিএর সাথে বসেছি, তারা বাঁধ সরানোর বিষয়ে আশ্বাসও দিয়েছে। সবসময় সিডিএ চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ রাখছি।
মেয়র বলেন, উড়ন্ত মশা নিধনে ওষুধ ছিটাচ্ছি। কিন্তু এর কার্যকারিতা দেখি না। এতে নিজের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে। তাই এজন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সাথে যোগাযোগ করেছি, তাদের গবেষণাগারে ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে বলেছি। তারা এখনো বিস্তারিত রির্পোট দেয়নি।
ফুটপাতকে হাঁটার উপযোগী করা : দখল হওয়া ফুটপাত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কঠোর অবস্থানে ছিলাম। ফুটপাত ও নালার উপর স্থাপনা করেও বিভিন্নভাবে দখল করা হয়েছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও উচ্ছেদ করা হচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, অনেক জায়গায় ফুটপাতের জায়গা থেকে কর্পোরেশন থেকে লিজ দেয়া হয়েছে। সেগুলোর বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নিয়েছি। একটা তদন্ত কমিটিও গঠন করে দিয়েছি। আমি সিটি কর্পোরেশনের জায়গা লিজ দিতে রাজি না। তিনি বলেন, আমানত শাহ মাজারের সামনের ফুটপাতে দোকান হয়ে গেছে, এটা তো দৃশ্যমান। এরকম আরো কিছু জায়গা আছে। সেখানে উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান আছে। আমার পরিকল্পনা আছে, ফুটপাত জনগণের চলাচলের উপযুক্ত করে জঞ্জালমুক্ত শহর গড়ে তুলব। এটা তো একশ দিনের মধ্যে সম্ভব না। তবে আমরা প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছি। তিনি বলেন, ফুটপাতে যেসব দোকানপাট নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলোর লিজ আগে দেয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে আজাদীতে প্রকাশিত হয় কাজীর দেউড়িতে ফুটপাতের উপর পোল দিয়ে দোকান করা হচ্ছে। সেটা আমি বন্ধ করে দিয়েছি। দোকান নির্মাণকারীরা চুক্তিপত্র নিয়ে আসে। তখন আমি তাদের বলে দিয়েছি, চুক্তি হলেও ফুটপাতে দোকান হবে না। ফুটপাত তো হাঁটার জায়গা। শেরশাহেও একই অবস্থা। এভাবে চলতে থাকলে ১০ বছর পর তো শহর পরিত্যক্ত জঞ্জালের শহর হয়ে যাবে। তাই এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর হতেই হবে।
আর্থিক সংকটই বড় প্রতিবন্ধকতা : দায়িত্বপালনকালে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে মেয়র আর্থিক সংকটকে প্রতিবন্ধক হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমাদের ফান্ডের সংকট আছে। ঠিকাদারদের কোটি কোটি টাকার বিল বকেয়া আছে। এতে তারা কাজে স্পৃহা হারিয়েছে। অর্থ সংকট থাকলে মনের মত করে কাজ করা যায় না। অর্থ সংকট দূরীকরণে স্থায়ী কোনো সমাধান আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজস্ব বাড়াতে হবে। মানুষের মধ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের প্রবণতা কম। ১০-১৫ তলা ভবনের মালিক হলেও অনেকের ভাবনাটা এমন, না দিলে কি হবে? তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাদের বকেয়ার পরিমাণ বেশি এবং সামর্থ্য আছে তাদের কাছ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আদায় করা হবে।
ট্রেড লাইসেন্সও আয়ের অন্যতম উৎস উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাজার হাজার দোকান থাকলেও অনেকের ট্রেড লাইসেন্স নেই। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো, ট্রেড লাইসেন্স ফি এর চেয়েও ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকা বেশি। তাই অনেকে অনাগ্রহী হচ্ছেন। কিন্তু ব্যবসা করতে হলে তো সবকিছু পরিশোধ করতে হবে। এজন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত শুরু করেছি। মেয়র বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব আয়ের এক শতাংশ সিটি কর্পোরেশনকে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন করা গেলে আমাদের আয় বাড়বে। এসময় বন্দর থেকে এসেসমেন্টের মাধ্যমে ধার্যকৃত ১৬০ কোটি টাকার পৌরকর আদায়ের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, তারা যৌথভাবে সার্ভের কথা বলেছে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। প্রয়োজনে তারা আপিল করতে পারবে। মেয়র বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোরও চিন্তা করা উচিত, চট্টগ্রাম শহর মেয়রের না। তাদেরও শহরের প্রতি প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। কিন্তু তারা নানা বাহানা করে কালক্ষেপণ করছে।
আলোকায়ন : গত ১০০ দিনে মধ্যে শহরকে আলোকিত করতে কাজ করেছেন জানিয়ে মেয়র বলেন, কালুরঘাট, শেরশাহসহ ৪২ কিলোমিটার সড়কে এলইডি লাইট লাগিয়েছি। আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসের মধ্যে পুরো শহরটাই আলোকিত হয়ে যাবে। কোথাও লাইটহীন থাকবে না।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : দায়িত্ব পালনের পূর্ণ মেয়াদ শেষে অর্থাৎ পাঁচ বছর পর শহরকে কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে? এমন প্রশ্নে মেয়র বলেন, এ বিষয়ে আগেও বলেছি। শহরকে বসবাসযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব করার জন্য সবার দায়িত্ব আছে। শুধু মেয়রের না। সবশ্রেণি পেশার, যারা শহরকে নিয়ে ভাবেন, চিন্তা করেন সবার পরামর্শ কাজে লাগাবো। কালেক্টিভ চিন্তা-ধারায় সমাজ ও দেশ এগিয়ে যায়। একক চিন্তায় এগুনো সম্ভব না। তাই প্রকাশ্যে সবার পরামর্শ গ্রহণে প্রক্রিয়া শুরু করে দিতাম। কোভিডের জন্য শুরু করতে পারিনি। এসময় আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনা আছে জানিয়ে বলেন, আয়বর্ধক প্রকল্প হলে অন্য কোথাও সাহায্যের জন্য চেয়ে থাকতে হবে না।
চট্টগ্রামের পর্যটন সম্ভাবনা এবং এখানকার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা আছে জানিয়ে মেয়র বলেন, সাগর, নদী ও উঁচু-নিচু পাহাড় আছে শহরে। এই তিনের সমন্বয় খুব কম জায়গায় আছে। এখানে সমুদ্র সৈকত আছে। শহরে অনেক ঐতিহাসিক স্থান আছে। পর্যটনশিল্পের মূল উপাদানগুলো শহরে আছে। এগুলোকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা আছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদ. জেলা বিএনপি নেতা আব্বাসের সুদ মওকুফের নথি চেয়েছে হাই কোর্ট
পরবর্তী নিবন্ধপূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ কাল দেখা যাবে সারা দেশে