প্রতিবছর ১০ই অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে এবং এই বিষয়ে সামাজিক স্টিগমা (ভুল ধারণা) দূর করার জন্য এই দিবসটি তৈরী করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর মতে মানসিক স্বাস্থ্য হচ্ছে ব্যক্তির এমন ক্ষমতা যার ফলে ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনের চাপের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে, উৎপাদনশীলভাবে কাজ করতে পারে এবং সমাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস যা বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস হিসাবেও পরিচিত। দিবসটি সর্বপ্রথম ১৯৯২ সালে পালিত হয়েছিল এবং তারপর থেকে এটি প্রতিবছর ১০ই অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের মূল উদ্দেশ্য হল বিশ্বব্যাপী যারা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন তাদের সকলের জন্য স্বাস্থ্যকর এবং সুখী জীবন উন্নীত করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান এবং কার্যকরী দিক নির্দেশনা প্রদান করা। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনা করার দ্বার উন্মোচন করেছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সহায়তা প্রদান করে আসছে যেখানে এখনও সহজে অ্যাঙেস যোগ্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করা হয়নি। এই বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ”কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সময় এসেছে।” এ থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যকে সতেজ রাখার জন্য একটি স্বাস্থ্যকর ও সুখময় কর্মপরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে পৃথীবির ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করা যায়, ১৯২৭ সালে শিকাগোর ওয়েষ্টার্ণ ইলেকট্রিক কোম্পানীর হথর্ণ শিল্প প্রতিষ্ঠানে এল্টন ম্যায়ো, রোয়েদ্ লিসবার্গার ও ডিকসন প্রমুখ মনোবিজ্ঞানীগণ কর্ম–পরিবেশ, দুর্ঘটনা ও একঘেয়েমি মনোভাবের সাথে সম্পর্ক নির্ণয় করার জন্য একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করেন। এই গবেষণা প্রকল্পটি হথর্ণ গবেষণা নামে বহুল পরিচিত। এই গবেষণার ফলাফলে প্রকাশ পায় যে, কর্মক্ষেত্রের প্রাকৃতিক পবিেশ ( যেমন আলোর তীব্রতা, বায়ু চলাচল, তাপমাত্রা, কার্যবিরতি, কর্মঘন্টা, কর্মসপ্তাহের পরিসর ইত্যাদি) এর চেয়ে কর্মক্ষেত্রের মানসিক ও সামাজিক পরিবেশ (যেমন ভাল মানবিক সম্পর্ক, সুষ্ঠু পরিদর্শন ব্যবস্থা, বন্ধুসুলভ সহকর্মী, কাজ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব, কর্মসন্তুষ্টি, সাংগঠনিক সংহতি, সুষ্ঠু নেতৃত্ব ইত্যাদি) উৎপাদনকে বেশী প্রভাবিত করে। বিশ্বব্যাপী অন্যান্য গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতি ৬ জনে ১জন কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং প্রতিবছর ১২ বিলিয়ন কর্মদিবস বিষন্নতা এবং উদ্বেগের কারণে হারিয়ে যায়। মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জের কারণগুলি জটিল হতে পারে এবং বিভিন্ন উৎস থেকে আসতে পারে যেমন–পরিবেশগত কারণ, জেনেটিঙ এবং সামাজিক প্রভাব। এছাড়া জীবনঘটিত অনেক কারণ থাকতে পারে যেমন–প্রিয়জনের মৃত্যু, সম্পর্কে টানা–পোড়ন, সম্পর্কের ভাঙ্গন ইত্যাদি। তাই কর্ম প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মীর অবস্থা বিবেচনা করে যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের একজন নেতা হিসাবে দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের লক্ষণগুলি চিহ্নিত করা অপরিহার্য। এটি না করলে যারা মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত তারা মানসিকভাবে আরও ভেঙ্গে পড়বে এবং সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পাবে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সাধারন লক্ষণগুলি হল – দুঃখিত মনে হওয়া, শক্তির অভাব, চিন্তায় বিভ্রান্তি, মনোনিবেশ করতে অক্ষমতা, কাজে দেরীতে আসা, অতিরিক্ত উদ্বেগ এবং ভয়, চরম মেজাজ পরিবর্তন, রাগ, আক্রমনাত্মক আচরণ এবং বিরক্তি দেখানো। পূর্বের তথ্যানুসারে প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১জন কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং যুক্তরাজ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিষন্নতায় ১৭.১ মিলিয়ন দিন নষ্ট হয়। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য কর্মক্ষেত্রের কর্মক্ষমতার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে যা কর্মীদের উৎপাদনশীলতা, অনুপস্থিতি, উপস্থিতি, কর্মীদের টার্ন ওভার, নিয়োগ কর্তার খ্যাতি এবং কর্মক্ষেত্রের কর্মীর মনোবলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কর্মক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানের নেতাদের একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠানো উচিত যে তারা কর্মীদের সক্রিয়ভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করবেন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। মানসিক স্বাস্থ্য অবস্থার কোন বন্ধ সুইচ নাই। সুতরাং কেউ যখন দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজে যোগ দেয় তখন মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ছাড়া তার পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। মানসিক স্বাস্থ্যের চ্যালেঞ্জগুলি আলোচনা করে মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করার জন্য একটি উন্মুক্ত ও বিশ্বস্ত পরিবেশ গড়ে তোলা দরকার। এটি একটি উন্মুক্ত এবং বিশ্বস্ত সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে যেখানে কর্মীরা তাদের সহকর্মী এবং ব্যবস্থাপকদের কাছে তাদের কষ্টগুলো প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপদ বোধ করে। ইতিবাচক কাজের সম্পর্ককে উৎসাহিত করে যারা মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জের সাথে লড়াই করে যাচ্ছেন তাদের চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিগুলি মূল্যায়ন করা দরকার। উপযুক্ত মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার অভাবে যারা কষ্টভোগ করছেন তারা একজন কাউন্সেলরের সাথে কথা বলে স্বস্তি অনুভব করতে পারেন এবং কাজের ভিতরে এবং বাইরে আরও ভাল এবং শক্তিশালী সম্পর্কের জন্য কাজ করতে পারেন। যখন একজন নিয়োগকর্তা কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং যত্নকে অগ্রাধিকার দেন, তখন কর্মীরা স্বাস্থ্যকর, সুখী এবং আরও বেশী করে কাজে নিয়োাজিত থাকে। এটি মানুষকে মূল্যবান, গুরুত্বপূর্ণ, নিরাপদ, সুখী এবং ক্ষমতায়িত করে। কিভাবে কর্মসংস্থাগুলি আরও ভাল মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দিতে পারে? একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য বিনামূল্যে এবং সহজে অ্যাঙেস যোগ্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান অপরিহার্য। এতে বোঝা যায় যে আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সম্পর্কে যত্নশীল এবং বিভিন্ন সংকট সমাধানে তৎপর। কর্মীরা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলি একজন কাউন্সেলরের কাছে শেয়ার করতে পারেন এবং তিনি তাদের যথাযথ মানসিক সেবা দিয়ে থাকেন। মানসিক স্বাস্থ্য একটি জটিল এবং সমৃদ্ধ বিষয় যা বুঝতে কঠিন। মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে কথা বলার জন্য একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানানো দরকার যিনি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কষ্টকর বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় মানসিক সেবা প্রদান করবেন। এটি কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে কৌতূহলী করে, স্টিগমাকে (ভুল ধারণা) ইতিবাচকভাবে মোকাবিলা করে এবং মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করে এবং সৎ কথোপকথনকে উৎসাহিত করে। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক সংহতি বৃৃদ্ধির জন্য টিম–বিল্ডিং কার্যকলাপগুলি সংস্থার কর্মীদের একে অপরের সাথে শক্তিশালী কাজের সম্পর্ক গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে যার ফলে দলের মধ্যে ব্যস্ততা, আত্মবিশ্বাস এবং বিশ্বাস বাড়ায়। কর্মক্ষেত্রের কর্মীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ এবং ভাল সম্পর্কের ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিপায় এবং একে অপরকে সমর্থন করার ক্ষমতা ও বৃদ্ধি পায়। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ সুন্দর ও সুস্থ রাখার জন্য কতগুলো পদক্ষেপ নেযা যেতে পারে – যেমন ১। প্রত্যেককে মানসিকভাবে সুস্থ ও সুন্দর হতে হবে ২। সহকর্মীর প্রতি সহমর্মিতা–সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে ৩। সহকর্মীর প্রতি বুলি বন্ধ করতে হবে ৪। মানসিক চাপমুক্ত থাকার কৌশল আয়ত্ত করা ৫। নিজের প্রতি আস্থা বাড়ানোর চেষ্টা করা/ ট্রেনিং নেওয়া ৬। অসুস্থ বসিং/ তোষামোদ বন্ধ করতে হবে ৭। মানসিক সমস্যাগ্রস্ত কর্মীদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা ৮। সহকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। পরিশেষে কর্মক্ষেত্রই আমাদের মূল ভরসার স্থল। জীবন–জীবিকা, উন্নতি–সমৃদ্ধি, যশ–সম্মান, অর্থ–বিত্ত সবই নির্ভর করে কর্মক্ষেত্রের উপর। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের গুরুত্ব তাই স্বাভাবিকভাবেই সবার উপরে স্থান পায়। তাই কর্মক্ষেত্রে সকলের সাথে সকলে মিলে মিশে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে কর্মপরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে সকলের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করবে যেখানে কোন মানসিক টানা–পোড়ন থাকবেনা, থাকবেনা কোন বৈষম্য এবং সহকর্মীরা পরস্পর পরস্পরের সহমর্মী হয়ে সহাবস্থানে অবস্থান করতে পারবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।