“কেটেছে রঙ্গিন মখমল দিন নতুন সফর আজ,/ শুনেছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক, / ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,/পাহাড়–বুলন্দ ঢেউ বয়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক; /নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি, সিন্দাবাদ! ”
সিন্দাবাদের সপ্তম সমুদ্র যাত্রার কাহিনি পড়ে রোমাঞ্চিত হবার ঘটনা ছোটবেলায় অনেকের স্মৃতিতে আছে। আর এই সমুদ্র বিজয়ী সিন্দাবাদদের যখন হাতের কাছেই পেয়ে গেলাম, ডুবেছিলাম অসীম এক ভালো লাগায়। মেরিন ফিশারিজ ইনস্টিটিউশনের ৪৩ তম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। শহর থেকে খানিক দূরে ইছানগরে এর অবস্থান কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষেই। বিশাল এলাকাজুড়ে নির্মিত এই ক্যাম্পাস টি এক কথায় অসাধারণ। সড়ক পথে যেতে হলে প্রচুর সময় ক্ষেপন হয়। আর নদীপথে মাত্র ৫ থেকে ৭ মিনিটেই ফেরা যায় শহরে। আমি যাওয়ার সময় সড়ক পথে আর ফেরার সময় নদীপথে ফিরেছি। ফলে আমার দু’পথই দেখা হয়ে গেলো। যাওয়ার পথে একঝাঁক মিডিয়াকর্মী ছিল, আর ফেরার পথে আমি একা, তখন নিজেই সিন্দাবাদ। উনাদের নিজস্ব বোটে করেই কর্ণফুলীর বুক চিরে শহরে ফিরেছি। সে এক অন্যরকম ফেরা। একেবারেই অল্প সময়ে, কিন্তু পড়ন্ত বিকেলটি আমার চোখের সামনেই সন্ধ্যায় পরিণত যখন হচ্ছিল, তখন আমি একাকী নদীর বুকে। সূর্যের অস্ত যাওয়া দেখলাম, সূর্যরশ্মির চিকচিক লালিমা নদীর জলের ঢেউয়ের সাথে মিশে গিয়ে কি এক অনিন্দ্য সুন্দর সন্ধ্যা যেনো আমায় উপহার দিয়েছিল। তখন আমন্ত্রণদাতাকে মনে মনে কুর্ণিশ জানালাম, সারাটা দিন তো ছিলাম অনাবিল আনন্দের জোয়ারে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্যরকম এক বর্ণিল উৎসবে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সরকারের মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আকতার। তিনি আমার খুবই শ্রদ্ধাভাজন এবং ঘনিষ্ঠজন। অনেক বছর পর উনার সাথে দেখা। কি আন্তরিকতায় তিনি আমায় কাছে টেনে নিলেন, শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসে। তাঁকে নিয়ে আলাদা করেই লিখবো। তিনি সনদপ্রাপ্ত নাবিক ক্যাডেটদের কুচকাওয়াজ ও অভিবাদন গ্রহণ করেন, এবং তাদের সনদ বিতরণ করেন। মাঝে নদীর পাড়ে চমৎকার চা–চক্র, দুপুরে ভোজ এবং বিকেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ক্যাডেটরা অংশগ্রহণ করেন। গান,নাচ, কৌতুক ও কথামালায় দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠান উপস্থিত সকলের কাছে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। অগণিত ছেলে নাবিকের পাশাপাশি মেয়ে নাবিকদের দেখে মনটা উল্লসিত হয়ে ওঠে। কি অসম সাহসী এই মেয়েরা। এই ইনস্টিটিউটে পড়তে এসে তারা নিজেদের জন্য নিঃসন্দেহে উন্নত এক ভবিষ্যৎ রচনা করেছে। কেউ আরো উচ্চ শিক্ষা নেবে, কেউবা জাহাজে যোগ দেবে চাকরি নিয়ে, সবাই কিন্তু অল্প বয়সী তরুণ–তরুণী। তাদের সাথে কথা বলেই, জানলাম, তারা একেবারে স্বেচ্ছায় এসেছে এই বিষয়ে পড়াশোনা করতে। তাদের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক, প্রাপ্তির উদ্ভাস। যেনো চঞ্চলা চপলা নির্ঝরিণী। আর এদের যারা এই অসম সাহসী পেশায় প্রশিক্ষিত করে তুলেছেন, তাদের একজন হলেন মেরিন ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের হেড সেলিনা ম্যাডাম। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়–এর মেরিন সায়েন্স এন্ড ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী। নিজ মেধা ও যোগ্যতাবলে আজ এই বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। তাঁরই নির্দেশনায় সেদিনের সারাদিনের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নাবিকদের সমাপনী দিবসটিকেই যেনো বরণীয় করে রাখে। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় যখন একের পর এক গান পরিবেশন হচ্ছিল,আমি ভাবছিলাম, এখন বুঝি কারো কণ্ঠে ভেসে আসবে সারেং বউ সিনেমার সেই বিখ্যাত গানটি, ওরে নীল দরিয়া,আমায় দে রে দে ছাড়িয়া…” না, সেই গানটি গায়নি বটে তবে তারা টাইটানিকের সেই রোমান্টিক গানটির সাথে জন আর কেটের মতোই নাচ করে দর্শকদের মুগ্ধ করে। আর কবিগুরুর “শেষের কবিতা” “কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?… তোমারে যা দিয়েছিনু, সে তোমারই দান, গ্রহণ করেছো যতো ঋণী ততো করেছো আমায়, বিদায়, হে বন্ধু বিদায়” বলেই এই সুন্দর অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। ৪৩ ব্যাচের ক্যাডেটদের সমাপনীর মতোই সেই ক্যাম্পাসেও ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসে। শেষ রাগিণীর বীণার মূর্ছনায় উচ্ছ্বল ক্যাডেটরাও ফিরে যার নিজস্ব আলয়ে। অত্যন্ত কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ জীবন থেকে কিছুটা মুক্তির স্বাদ নিতে ফিরে যায় পরিবারের কাছে। যাবার বেলায় একে অপরকে যেনো বলছিল তারা “মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্যম, মোরা ঝর্ণার মতো উচ্ছ্বল। মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মতো স্বচ্ছল।”