কর্ণফুলীর বুকে ‘পলিথিনের চর’

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৫ মে, ২০২১ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

কর্ণফুলী নদীতে প্রতি মাসে দেড় কোটিরও বেশি পলিথিন পড়ছে। এতে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ রকমের জঞ্জাল। এছাড়া নদীর তলদেশে ২৫ ফুটের পলিথিন আস্তরণের কোনো সুরহা না হওয়ার আগেই প্রতিদিন পড়ছে আরো লাখ লাখ পলিথিন। এতে তৈরি হচ্ছে নতুন সংকট। ইতোমধ্যে প্রতিটি খালের মুখ ঘিরে পানির উপরে তৈরি হয়েছে পলিথিনের বিশাল স্তূপ। যেন কর্ণফুলীর বুকে তৈরি হয়েছে ‘পলিথিনের চর’। খাল-নালা হয়ে নদীতে পড়া এসব পলিথিন শুধু কর্ণফুলীতে নয়; বঙ্গোপসাগরেও ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি করছে। নদীর পানিতে বিপুল পরিমাণ পলিথিন ভাসমান অবস্থায় আস্তরণ সৃষ্টি করছে। যা নদীর জীববৈচিত্রও ধ্বংস করছে। এছাড়া এসব পলিথিনের জঞ্জাল অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত কর্ণফুলীকে ক্রমে মেরে ফেলছে। নগরীর পলিথিন জঞ্জালের ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ এবং নাগরিক সচেতনতা তৈরি না হলে চট্টগ্রামের এই নদী রক্ষা করা কঠিন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত ও জোয়ার ভাটা নির্ভর কর্ণফুলী নদীর উপরই দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের সিংগভাগ নির্ভরশীল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের জঞ্জালের কারণে কর্ণফুলী নদীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠছে। যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে চট্টগ্রাম বন্দরে। ইতোমধ্যে বন্দরের এক নম্বর জেটিসহ সন্নিহিত এলাকা পুরোপুরি ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চারত্রিক বৈশিষ্টের কারণে কর্ণফুলী নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হয়। এই নদীতে প্রচুর পলি পড়ে। নদীর যে কোনো অংশে পুঁতে দেওয়া একটি খুঁটিকে ঘিরে অতিদ্রুত পলির আস্তর জমাট হতে শুরু করে। যা নদী ভরাট করে ফেলে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব জাহাজ দিয়ে প্রতিদিনই নদীর কোনো কোনো এলাকায় ড্রেজিং চালায়। বিশেষ করে মোহনা থেকে নিচের দিকে নিয়মিত এই ড্রেজিং কার্যক্রম চলে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়মিত এই কার্যক্রমে ভরাট পুরোপুরি ঠেকানো যায় না। তোলা সম্ভব হয় না সব পলি। এতে দশ বছর অন্তর বড় ধরনের ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনে নদীতে ড্রেজিং কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়নি।
চট্টগ্রামের ৭০ লাখ মানুষের অর্ধেকও যদি সপ্তাহে একটি পলিথিন ব্যবহার করে তাহলে মাসে ব্যবহৃত পলিথিনের সংখ্যা দাঁড়ায় দেড় কোটির কাছাকাছি। এই বিপুল সংখ্যক পলিথিনই নদীর তলদেশে ২৫ ফুটের পলিথিন আস্তরণ তৈরি করেছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন না করলে নদীর তলদেশে এই ধরনের পলিথিন স্তরের ভয়াবহ খবরই মানুষের অজানা থেকে যেতো।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ আরিফ বলেন, কর্ণফুলীর তলদেশে অন্তত ২৫ ফুটের একটি পলিথিন আস্তরণ তৈরি হয়েছে। যা কেটে তোলা এক কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পলিথিন আস্তরের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করা সম্ভব হয়নি। সময় এবং ব্যয় দুটোই বাড়িয়ে নদীর তলদেশের পলিথিন আস্তরণ তুলে আনতে হচ্ছে। নদীর তলদেশে ছয় মিটারেরও বেশি পুরু পলিথিন স্তর তৈরি হওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।
নদীর তলদেশের ভয়াবহ এই পলিথিন আস্তরের কোন সুরহা করা না গেলেও প্রতিদিন লাখ লাখ পলিথিন নদীতে গিয়ে পড়ছে। নগরীর নানা অঞ্চলে ব্যবহৃত পলিথিন নালা এবং খাল হয়ে গিয়ে পড়ছে নদীতে। এতে খালের মুখ বরাবর নদীর বুকে পলিথিনের দ্বীপ তৈরি হয়েছে। এই ধরনের প্রতিটি দ্বীপে লক্ষ লক্ষ পলিথিন স্তুপাকারে জমাট বাঁধছে। যা ক্রমে নদীর তলদেশে গিয়ে নতুন করে সংকট তৈরি করবে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
নদীর পানির উপর বিপুল পরিমাণ পলিথিনের স্তুপ কর্ণফুলীর জীববৈচিত্রের জন্য বড় ধরনের সংকট তৈরি করছে। নদীতে অক্সিজেন প্রবাহ ব্যাহত করছে। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। যা নগরীর জলাবদ্ধতা পরিস্থিতিতে মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিষয়টি নিয়ে কর্ণফুলী গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ ইদ্রিস আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দেশে গত পঞ্চাশ বছর ধরে পলিথিন ব্যবহারের আত্মঘাতি কর্মকাণ্ড চলে আসছে। অথচ এই পলিথিন প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। চট্টগ্রাম শহরের ৭০ লাখ লোকের অর্ধেকও যদি সপ্তাহে একটি পলিথিন ব্যবহার করে তাহলে কী পরিমাণ পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে তা ধারণার বাইরে। এই পলিথিন নগরীর নালা খাল ঘুরে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। পড়ছে বঙ্গোপসাগরেও। শুধু কর্ণফুলী নদীতেই নয়; বঙ্গোপসাগরের তলদেশেও বিশাল পলিথিন আস্তর তৈরি হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, নদীর তলদেশে ২০/২৫ ফুটের পলিথিন আস্তর জীববৈচিত্র ধ্বংস করছে। বিলুপ্ত করছে মাছসহ জলজ প্রাণি। এখন নদীর উপরেও পলিথিনের স্তুপ পুরনো সংকটকেই আরো প্রকট করবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, পলিথিনের ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে জাতিকে চড়া মূল্য দিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ কাল দেখা যাবে সারা দেশে
পরবর্তী নিবন্ধবাবুল আক্তারের সরাসরি ডিভিশন আবেদন নাকচ