কর্ণফুলীতে ৫১১ মিটার রাস্তায় ব্যয় ৫২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা !

জে. জাহেদ, নিজস্ব প্রতিবেদক | রবিবার , ১৪ জুলাই, ২০২৪ at ৫:৩১ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় ৫১১ মিটার দৈর্ঘ্যের রাস্তা নির্মাণে খরচ হচ্ছে ৫২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। সে হিসেবে ১ হাজার মিটার রাস্তা করতে খরচ হবে ১ কোটি ২ লাখ ৬২ হাজার ২৩০ টাকা।

কাজটি চলছে উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। রাস্তাটির নাম ‘নুর মোহাম্মদ সড়ক’। অনেকেই এ সড়ককে মৌলানা নুর মোহাম্মদ সড়ক হিসেবে জানেন। আর এই ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে স্বয়ং সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জাহাঙ্গীর আলম।

এই ব্যয়কে তিনি বর্তমান বাস্তবতায় অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান মনে করছেন।

উপজেলা এলজিইডি অফিসের নথিপত্র বলছে, রাস্তাটি আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন করা হচ্ছে। আরসিসি মানে রিইনফোর্সড সিমেন্ট কংক্রিট। অর্থ্যাৎ সিমেন্ট, মোটা নুড়ি এবং পানি দিয়ে তৈরি কংক্রিটকে লোহার দণ্ডের সাহায্যে শক্তিশালী করা।

রাস্তার এ কাজটি পেয়েছেন মেসার্স জে. কে এন্টারপ্রাইজ নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির মালিক কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা এলাকার। ঠিকাদারের নাম মোহাম্মদ ফোরকান। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তর।

যদিও, সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা গবেষণায় বারবার উঠে এসেছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় সবচেয়ে বেশি। এমনকি সড়কের মান ও ব্যবস্থাপনায় দেশের অবস্থান একদম তলানিতে। সুতরাং আরেকটু যাচাই-বাছাই করে রাস্তার এস্টিমেট বা অনুমান দেওয়া যায় কিনা কর্ণফুলী এলজিইডি’র প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন শিকলবাহা এলাকার লোকজন।

সাধারণত সমস্ত প্রকৌশল কাজের সম্ভাব্য পরিমাণ ও পরিব্যয় নির্ণয়ের পদ্ধতিকে এস্টিমেট বা অনুমান বলে। সেক্ষেত্রে নুর মোহাম্মদ সড়কের বেলায় ৫১১ মিটার রাস্তায় যদি ৫২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা খরচ হয়, তবে ১০০০ মিটার রাস্তা করতে খরচ পড়বে প্রায় ১ কোটি ২ লাখ ৬২ হাজার টাকার উপরে।

ওদিকে, গ্রামীণ এইচবিবি সড়ক মানে হেরিং বোন বন্ড রাস্তা। সোজা বাংলায় ডাবল ইট বসানো রাস্তা। এ ধরণের একটি রাস্তা কুঁড়ে সেখানকার ইটগুলো তুলে তারপর কংক্রিট করে কিছু রড দিয়ে আরসিসি ঢালাই দিচ্ছে শিকলবাহার নুর মোহাম্মদ সড়কটি। যদিও স্টোরেজ কস্ট কেটে নেওয়া হয়েছে। পরে ওই টাকায় আদৌও কোন অন্য প্রকল্প হবে কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এলজিইডি অফিসের নথি বলছে, সড়কটির প্রকল্প কোডের শেষের তিন ডিজিট-৭০০। প্রাতিষ্ঠানিক অপারেশন কোড নম্বর-১৩৭০৩০৫১২০১৪৪। প্রকল্পটি ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বরাদ্দ থেকে করা হচ্ছে। যার প্যাকেজ নম্বর-এডিপি-০১। রাস্তাটির কাজ এখনো চলমান। অথচ, ব্যাংক থেকে সম্পূর্ণ বিল উত্তোলন হয়েছে গত মাসের ২৩ তারিখ। মানে ২৩ জুন।

তথ্য বলছে, কর্ণফুলী উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তরের যার বিল নম্বর-০১/২৩-২৪। বিলটির নিচে কর্ণফুলী উপজেলার ফকিরনিরহাট পূবালী ব্যাংক পিএলসি উপ-শাখার সিনিয়র কর্মকর্তা মো. মোর্শেদুল হকের স্বাক্ষর দৃশ্যমান।

এমনকি ইতিমধ্যে মোট বিল ৫২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা থেকে ৫ শতাংশ আয়কর, সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট, ১০ শতাংশ ঠিকাদারের নিরাপত্তা জমা ও স্টোরেজ কস্ট মানে সংরক্ষণ খরচ বিল অনুযায়ী কেটে নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জে. কে এন্টারপ্রাইজ এর মালিক মো. ফোরকান বলেন, ‘নুর মোহাম্মদ সড়কের ৫১১ মিটার রাস্তার কাজটি আমি লটারিতে পেয়েছি। এটা এলটিএম অনলাইন ই-জিপি। রাস্তায় দুটি ইউ ড্রেনসহ কাজ করতেছি পাশে ১০ ফিট ৮ ইঞ্চি। ঢালাই হবে ৯ ফিট। প্রস্থ ৯ ফিট। গাঁথুনি ১০-১০ ইঞ্চি। যতটুকু কাজ করেছি তার বিল দিয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদ এর চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জাহাঙ্গীর আলম বলেন,’ এতটুকু সড়কের জন্য প্রায় ৫৩ লাখ টাকা ব্যয় বর্তমান বাস্তবতায় বেশি মনে হচ্ছে। লম্বায় ও প্রস্থে প্রকৃতপক্ষে কতটুকু কাজ করেতেছে সেটাও প্রকৌশলীদের দেখা উচিত। কোন অনিয়ম হচ্ছে কিনা। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ কমিয়ে যৌক্তিক করা উচিত বলে আমি মনে করি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্ণফুলী উপজেলার এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক জানান, ‘কাজের মান এবং কাজ কতটুকু হয়েছে তা আমি জানি না। তবে ৫১১ মিটার রাস্তার জন্য ৫২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা খুব বেশি হয়েছে বলে মনে করি না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মো. জাহেদুল আলম চৌধুরীর মুঠোফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে কল করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বারবার ফোনে করলে ফোন বিজি দেখা যায়। প্রতিবেদকের ধারণা নম্বর ব্লক লিস্টে রেখেছেন।

বিল উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এসব তো জুনে নিয়ে নেবার কথা। এখন কোন বিল পেন্ডিং থাকবে না। ঠিকাদার নিয়ে গেছে কিনা আমি বলতে পারব না। কারণ এসব এডিপি বিল ডিডিও’র নামে মানে আয়ন ব্যয় কর্মকর্তা অফিস প্রধান হিসেবে ইউএনও’র নামে ইস্যু হয়। এরপর আমাদের আর কিছু জানায় না।’

চট্টগ্রাম নির্বার্হী প্রকৌশলী কার্যালয় (এলজিইডি) এর সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী সুমন তালুকদার বলেন,’ এডিপি প্রকল্পের কাজ আমরা করি না। এসব কাজ উপজেলা পরিষদ করে থাকেন। এ বিষয়ে ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যান তথ্য দিতে পারবে।’

এ বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত এর মুঠোফোনে কল করা হলেও ফোন রিসিভ হয়নি।

একই বিষয়ে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল মালেক বলেন, ‘রাস্তার কাজে অনিয়ম হলে যে কেউ দুদকে লিখিত অভিযোগ দিতে পারে। তারপর আমরা তা ঢাকায় পাঠাবো। সেখান থেকে এপ্রুব হলে তদন্ত করে দেখবো কোন অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কিনা।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনুমোদন ব্যতীত বোতলজাত পানি বিক্রি, চন্দনাইশে ২ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
পরবর্তী নিবন্ধবোয়ালখালীতে বালুবাহী ডাম্পারের সাথে বাইকের সংঘর্ষ, নিহত ১