কর্ণফুলীতে ১ কোটি টাকা বিল তুলে দুই কোটি টাকার কাজ বিক্রি করে ঠিকাদার উধাও!

জে. জাহেদ, কর্ণফুলী | বৃহস্পতিবার , ১১ জুলাই, ২০২৪ at ৬:৪৪ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দের ‘চরলক্ষ্যা হাসপাতাল সড়ক’ এ ইটের খোয়া বিছিয়ে ১ কোটি টাকা বিল উত্তোলন করে ৪ বছর ধরে লাপাত্তা ঠিকাদার।

এমনকি পরে লাভে কাজটি সাব ঠিকাদারকে বিক্রি করলে সাব ঠিকাদারও কাজ না করে উধাও। এতে যাতায়াতে ভোগান্তিতে পড়েছে কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা ও চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের বাসিন্দারা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সরকার প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে এ রাস্তাটি মেরামত করার জন্য ২০২১ সালে বরাদ্দ দিলেও বর্তমানে সড়কটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদার পুরো রাস্তায় ইটের খোয়া বিছিয়ে এলজিইডি অফিসের প্রকৌশলীকে ম্যানেজ করে এক কোটি টাকার উপরে বিল উত্তোলন করে নীরব হয়ে গেছেন।

পরে বাকি কাজটি লাভে স্থানীয় সাব-ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে দেন মূল ঠিকাদার। ফলে, সাব-ঠিকাদারেও কাজের কোন অগ্রগতি নেই গত ৪ বছর। অথচ দৃষ্টি নেই উপজেলা এলজিইডির। এমন কি মূল ঠিকাদার কাজ বিক্রি করে চলে গেলেও এত বছর কিছুই করেনি এলজিইডির কর্মকর্তারা। সম্প্রতি প্রতিবেদক এ বিষয়টি জানতে চাইলে নড়েচড়ে বসে এলজিইডি অফিস।

ওই এলাকার বাসিন্দা মো. ওসমান হোসাইন বলেন, ‘রাস্তাটিতে ৪ বছর ধরে বিনা রোলারে খোয়া বিছিয়ে রেখেছে। উপজেলা এলজিইডি আর উপজেলা পরিষদ দেখেও দেখেন না। আসলে সব মিলিয়ে রাস্তার কাজটি সম্পূর্ণ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না তা জানি না, তবে উন্নয়নের নামে সাধারণ মানুষকে এভাবে ভোগান্তিতে ফেলা ঠিক হচ্ছে না। আমরা সাবেক ভূমিমন্ত্রীকে বিষয়টি জানাবো।’

সরেজমিনে দেখা যায়, এ সড়কের পাশেই রয়েছে শিকলবাহা-চরলক্ষ্যা লেংগ্যা খাল। সড়কের খাল সংলগ্ন পাড় পাকাপোক্ত না করে রাস্তাকে পাড় হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে এতে এলজিইডির কোটি কোটি টাকার সড়ক নির্মাণের আগেই দুর্বল গাইডওয়াল ভেঙে খালে পড়ে গেছে। এজন্য মেইনটেইন্স বাবদ সরকার অন্য বরাদ্দ দিলেও সে ঠিকাদারও লাপাত্তা। বর্তমানে কাজ বন্ধ। কিন্তু রাস্তায় খোয়া বিছানোই আছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এসব নিম্নমানের খোয়া বিছানো হয়েছে।

উপজেলা প্রকৌশলী মো. জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর কার্যালয়ে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। দরজা বন্ধ।
তাঁর মোবাইল ফোনে মেসেজ দিয়ে রাস্তাটির বিষয়ে জানতে চাইলেও কোন উত্তর দেননি। পরে কল করলেও তিনি কলটি কেটে দেন। অফিস সহকারি জসিম উদ্দিনকে পর পর দুদিন কল করা হলেও সড়কটির তথ্য দিতে নানা লুকোচুরির আশ্রয় নেন তিনিও। বলতে গেলে মুখ খুলতে রাজি না কেউ। পরে বাধ্য হয়ে জেলা এলজিইডি কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে হয়।

জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা হাসপাতাল সড়কটির দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। যার টেন্ডার আইডি ছিলো-৪৫২৬৩৭। ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজের চুক্তি সম্পাদিত হয়। সড়কটির কাজ পান নগরীর হালিশহর কে ব্লক এলাকার মেসার্স হক এন্টারপ্রাইজ নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

আরো তথ্য মিলে, বৃহত্তর চট্টগ্রাম গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩ এর আওতায় সড়কটি কাগজ কলমে নাম চরলক্ষ্যা হসপিটাল রোড। সড়ক ও জনপদ (সওজ) মতে কাজটির শুরু করার কথা চরলক্ষ্যা সোলতানুল আউলিয়া থেকে আলী হোসাইন মার্কেট গোয়াল পাড়া পাইপের ঘোড়া বাজার পর্যন্ত। কাজটি করার কথা বিটুমিনাস কংক্রিট ও কার্পেটিং করে। প্রথম পার্ট ছিলো ১ হাজার ৫৫০ মিটার এবং দ্বিতীয় পার্টে ছিলো ৪৫০ মিটার। মানে সর্বমোট ২ হাজার মিটারের রাস্তা। কাজের সময়সীমা ছিলো ১০ মাস। কাজটির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিলো ১ কোটি ৮৭ লাখ ৫৪ হাজার ৯১২ টাকা ৪১ পয়সা। প্রায় দুই কোটি বলা যায়।

ওদিকে, কেন বিগত ৪ বছর যাবত চরলক্ষ্যা হাসপাতাল সড়কের কাজ সম্পন্ন হয়নি জানতে চাইলে ঠিকাদারের কাছ থেকে বেরিয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। কিন্তু সাব ঠিকাদারেরাও কেউ এ বিষয়ে কথা বলতেও রাজি না। চরলক্ষ্যা ইউপি চেয়ারম্যান সোলায়মান তালুকদার বলেন, ‘এলজিইডি কে অনেক বার বলেছি কিন্তু কাজটি কেউ করছে না। শুনেছি এখন রি-টেন্ডার হবে।’

এ বিষয়ে মেসার্স হক এন্টারপ্রাইজের মালিক মফিজুল হক বলেন, ‘আমার ব্যবসা হালিশহরে। ২০২০ সালের দিকে আমি আমার কাজের স্যান্টারিংয়ের জন্য কিছু গাছ কিনেছিলাম হালিশহর ফইল্লাতলী বাজারের স-মিলের মালিক কাঠ ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর আলম এর কাছ থেকে। পরিচয়ের পরে একদিন সে হুট করে আমার কাছ থেকে ঠিকাদারি ফার্ম নেন। কিছুদিন পর দেখি আমার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হক এন্টারপ্রাইজ এর নামে কর্ণফুলীর চরলক্ষ্যা হাসপাতাল সড়কের প্রায় দুই কোটি টাকার পান তিনি। আমি কোন ওখানে ইনভেস্ট করিনি।’

হক এন্টারপ্রাইজ আরও জানান, ‘পরে দেখি সে সড়কের কিছুটা কাজ করে আর করেনি। এরমধ্যে আমার মেইলে এলজিইডি থেকে বারবার নোটিশ আসে। ফোন আসে। এটা নিয়ে আমি দীর্ঘদিন অনেক কষ্ট পাইছি। তারপরেও কাজটি করতে তাঁকে টাইম এক্সটেনশন করেও দিয়েছিলাম। পরে আমি তাঁকে তাগিদ দিলে সে তাঁর ফুফাতো ভাইকে দিয়ে কাজটি করার কথা জানান। শুনেছি ১ কোটি টাকার উপরে বিলও উত্তোলন করে নিয়েছেন।’

ঠিকাদার মফিজুল হক ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আরও বলেন,’ আমি যখন জাহাঙ্গীরকে দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করতে পারতেছি না। পরে আমি কর্ণফুলীর শাহেদ নামে একজনকে কাগজ তৈরি করে দিই। সে বাকি কাজটি করবে বলে। কিন্তু এরপর কে কী করেছে আমি জানি না। গতকাল মেইল পেলাম কাজের চুক্তি ভঙ্গের দায়ে চুক্তি বাতিলের।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ হাসান আলী লিখিত ভাবে জানান, ‘দরপত্রের শর্তাবলী ও দি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রোলস ২০০৮ ভঙ্গ করায় ঠিকাদারের চুক্তি বাতিলের চূড়ান্ত নোটিশ গত মাসের ১২ জুন দেওয়া হয়েছে।’

অথচ মেসার্স হক এন্টারপ্রাইজের মালিক মফিজুল হক প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন তাঁকে মেইল পাঠানো হয়েছে মাত্র গতকাল। যখন সে কুমিল্লায় ছিলেন। পরে মেইলটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় তাঁতে তারিখ দেখানো হয়েছে ১২ জুন। এতে এটাই স্পষ্ট কর্ণফুলী এলজিইডি অফিস ও জেলা এলজিইডি কার্যালয় গত ৪ বছরে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। সড়কটির বিষয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা খোঁজ খবর নিতে গেলে তাঁদের টনক নড়ে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে আবারও পাহাড় ধসে গৃহবধূর মৃত্যু, শিশু আহত
পরবর্তী নিবন্ধসাতকানিয়ায় ৪ বেসরকারি হাসপাতালকে জরিমানা