হঠাৎ করেই বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ যেন বৃদ্ধি পেল। শুধু বাংলাদেশ নয়, সমপ্রতি বেশকিছু দেশে এর দৈনিক সংক্রমণ বেড়েই চলছে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে কোভিড আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর সামনে আসছে অহরহ। আমরা একটু পেছনে ফিরলে দেখি, গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে বাংলাদেশে করোনা তার বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল, ঠিক তেমনিভাবে এ বছরেরও এই সময়েও এসে করোনা তার রুক্ষ চেহারা প্রদর্শন করছে আমাদের পরিবেশ ও মানবকুলে। সঙ্গে যোগ হয়েছে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইত্যাদি। গত ১ জুলাই থেকে সরকার বাধ্য হয়েছে কঠোর লকডাউন দিতে। পরে সময়সীমা হয়তো বাড়তে পারে। কঠোর লকডাউনে জরুরি পরিষেবা ব্যতীত সরকারি-বেসরকারি সকল অফিস বন্ধ থাকবে। নির্দিষ্ট কিছু কারণ ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। অহেতুক বাইরে বের হলে গ্রেফতার, জরিমানার কথা বলা হয়েছে। অথচ কি আজব আমরা! এখন সেই কঠোর লকডাউন কিভাবে চলছে, সেটা দেখার জন্য অনেক মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে। কি অহেতুক উৎসাহ। কঠোর লকডাউন ঘোষণা অপ্রত্যাশিত হলেও এর পেছনে সাধারণ মানুষের আইন না মানার প্রবণতা এবং মহামারীকে অবজ্ঞা করার মনোভাবই কার্যত দায়ী। গত ঈদে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মানুষ যেভাবে ঘরমুখো হয়েছে তা কোনো সভ্যসমাজে মহামারীর সময় কল্পনা করাও কঠিন। জনসমক্ষে মাস্ক ব্যবহারে সরকারের কঠোর হওয়া উচিত। আমরা দেখেছি, গত বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ছিল, যে কারণে সঠিক সময়ে করোনা পরীক্ষা না হওয়া, হাসপাতালে আসন সঙ্কট, চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা, নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার মতো বড় বড় বিষয় সামনে চলে এসেছে। এদিকে আমরা দেখছি, করোনার ভারতীয় ধরন ডেল্টার পরে ভারতে ডেল্টা প্লাস নামে করোনার নতুন একটি ধরনের সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে। ডেল্টা প্লাস ধরনটি নতুন করে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। অনেক চিকিৎসা বিজ্ঞানী বলছেন, ভারতে বর্তমানে ডেল্টা ধরনটি দুর্বল হয়ে ‘ডেল্টা প্লাস’ সবল হয়ে উঠতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে ভারতে ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহের মধ্যে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগের বলে আমি মনে করি। করোনাভাইরাসের মতো এই নাজুক পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা পেতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বললেও আমাদের দেশের সাধারণ মানুষেরা স্বাস্থ্যবিধি তথা মাস্ক পরিধান, হ্যান্ড গ্লাভস, স্যানিটাইজার ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘন ঘন হাত ধোয়া ও প্রয়োজন ব্যতীত বাইরে যাওয়া কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। বরং পূর্বের চেয়েও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি আরো অনীহা ও বেখেয়ালিপনা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা প্রতিনিয়ত এই ভাইরাসের বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নির্দেশিকা অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা ছাড়া এই মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে পাড়া, মহল্লা বা গ্রামভিত্তিক কমিটি গঠন করা যেতে পারে যেখান থেকে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা, দরিদ্র মানুষের খাদ্য সহায়তা প্রদান ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় সহযোগিতা, যেমন অ্যাম্বুলেন্স ডাকা, হাসপাতালে নেওয়া, অক্সিজেনের সরবরাহ ইত্যাদি ব্যবস্থা নিতে পারে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের প্রশাসন যেমন গ্রামপর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারে। প্রশাসনের মাধ্যমে সরকার জনসাধারণের মধ্যে খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা, অনুদান ও জরুরি ওষুধ সরবরাহ করতে পারে। বেসরকারি সংস্থাগুলোও এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এখন কোনো অবস্থাতেই কথিত লকডাউনের পথে হাঁটলে চলবে না। তাহলে জীবন যেমন রক্ষা পাবে না, তেমনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে সর্বনিম্ন ৩ ফুট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে যা আমাদের দেশে মেনে চলার কোন চিহ্নও নেই। সামাজিক দূরত্ব বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। সামাজিক দূরত্ব এবং শারীরিক দূরত্ব উভয়ই একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজনে সরকার যে কঠোরতা কথা বলেছেন, তা বাস্তবায়নে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীর সময়োচিত পদক্ষেপ কামনা করি। জনগণকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। দরকার হলে তাকে জেল-জরিমানায় আটকাতে হবে। মনে রাখতে হবে, উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে করোনায় কাছে পরাজিত হলে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে। দিন দিন কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়বে। শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। দুর্ভিক্ষ শেষ করে দেবে জীবন ও জীবিকা।
সামনে কোরবানির ঈদ, এর আগে লকডাউনে সবকিছু অচল থাকলে গার্মেন্ট কর্মীর বেতন-বোনাস দেওয়া সম্ভব হবে কিনা ভাবনায় পড়ছেন মালিকরা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছে বেসরকারি চাকরিজীবীরাও। ঈদের আগে নতুন করে বিপাকে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে দোকানের কর্মচারী থেকে করপোরেট চাকরিজীবীদের মধ্যে। ১৬ মাসের দীর্ঘ মহামারী মোকাবেলা করে যখন আশার আলো দেখতে শুরু করেছিলেন ঠিক তখন আবার দুর্ভাবনায় পড়ছেন পেশাজীবীরা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ব্যাংকের পাশাপাশি যেসব খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয় সেসব প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা উচিত। ভূমি রেজিস্ট্রেশন, কর আদায়, ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহসহ রাজস্ব আদায়ের খাতগুলো খোলা রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অন্যথায় লকডাউনের কারণে রাজস্ব আদায় করতে না পারলে সরকারের সব প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়বে।
করোনার বিস্তাররোধে আরোপিত লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের নিম্ন আয়ের কর্মজীবী মানুষ। একাধিক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, করোনা শুরু থেকে এ পর্যন্ত দেশে প্রায় আড়াই কোটি বা তারও বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। সুতরাং এই বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে এলে এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব। দেশে করোনা জরুরি অবস্থায় মানুষ যেন আতঙ্ক নয়, আস্থার সঙ্গে এই বিপদ মোকাবেলায় অংশ নিতে পারে।
লেখক : চেয়ারম্যান, এলবিয়ন গ্রুপ।