কেভিড-১৯ মহামারির কারণে প্রচুর ক্ষতি হলেও ডিজিটালাইজেশন সমপ্রসারণের ক্ষেত্রে এটি বিরাট ভূমিকা রেখেছে। মহামারিজনিত লক ডাউন, ডিজিটালাইজেশন এবং চতুর্থশিল্প বিপ্লব (ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়েল রিভল্যুাশন বা ফোর আই আর) সহ সবকিছুই বৈশ্বিক শাসন ও পরিচালন ব্যবস্থার খোলনচে বদলে দিচ্ছে। জাপানের বিশ্ববিখ্যাত মোটর কোম্পানি টয়োটার গবেষণা ফেলো ‘জেফরি কে লিকার’- তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য টয়োটা ওয়ে: ফোরটিন প্রিন্সিপ্যাল’ – এ বলেন ‘১৪ টি ব্যবস্থাপনার পদ্ধতির মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বা ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ’। করোনা মহামারির এই চরম বাস্তবতায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার আরো বেশি করে মানুষের জীবনে ধরা দিচ্ছে। কোভিড-১৯ এ রোগীর অবস্থার অনুসরণ, রোগী শনাক্তকরণ, শারীরিক পরীক্ষা করা, মহামারি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া, ঘরে বসে অফিসের কাজ করা, এক দেশের মানুষের সাথে অন্যদেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন, এক দেশ থেকে আরেক দেশের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া, অন লাইনে সকল প্রকারের যোগাযোগ, ই-কমার্স চালিয়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বা ফোর আই আর প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। প্রাত্যহিক জীবনের নানা অনুষঙ্গের মধ্যে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে কোভিড-১৯ মহামারির পড়ে আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব বিস্তারের দৌড়ে প্রাথমিক ধাপ হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ফোর আই আর প্রযুক্তির প্রতিযোগিতা। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিক থেকে আমরা যেমন দেখেছি পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার এক লাগামহীন প্রতিযোগিতা চলছিল, যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটু আগে আরো বেগবান হয়েছিল, ঠিক তেমনি কোভিড-১৯ এর সময়টাতে বা এরপরে ডিজিটাল প্রযুক্তি হয়ে উঠেছে মানুষের যাপিত জীবনের এক বিশাল অনুষঙ্গ। ডিজিটালাইজেশন ও পারমাণবিক শক্তি প্রসঙ্গে বহুকাল আগে বার্ট্রন্ড রাসেলকে তাঁর এক ভক্ত কৌতূহলী হৃদয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র পরাশক্তিরা ব্যবহার করতে পারে? বার্ট্রান্ড রাসেল এ প্রশ্নে বিন্দু মাত্র হতচকিত বা বিস্ময়াভিভূত বা আশ্চর্যান্বিত হননি। বরং দৃঢ প্রত্যয়ে জবাব দিয়েছিলেন,‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আদৌ হবে কিনা, আর হলেও বিধ্বস্ত পৃথিবীতে মানুষসহ কোন প্রাণীর অস্তিত্ব থাকবে কিনা আমি বলতে পারব না। যদি আদৌ থাকে তবে প্রাগতিহাসিক যুগের মনুষ্য প্রাণীর মতো যে পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি করবে, তা অনুমান করে বলা যায়’।
কথাটি অবিসংবাদিত নিষ্ঠুর বাস্তব। বিজ্ঞান ও ডিজিটাল প্রযুক্তি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যা বলি না কেন বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে প্রবল গতিতে। যে গতির পালে নতুন করে অতিরিক্ত গতি যোগ করেছে এই করোনা মহামারি। এই গতিবেগের হাওয়ার প্রবল প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার দেশগুলোও কৃএিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল প্রযুক্তি বা ফোর আই আর উদ্ভাবন ও ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। যেমন যুক্তরাজ্য তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে পর্যাপ্ত তহবিল সরবরাহ করে এ আই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্ট) এর প্রস্তুতির দিক থেকে শীর্ষ চারটি দেশের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। পাল্টে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষপট ও অর্থনৈতিক দৃশ্যপট। করোনার এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধির কারণে জনসমাগম ও জটলা বন্ধ হয়ে গেছে, তাই প্রযুক্তির অবশ্যাম্ভাবী ব্যবহার বেড়েছে। যেমন জুম, ওয়েবিনার, মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, টিমস ইত্যাদির মাধ্যমে চলছে ব্যক্তিগত, অফিশিয়াল, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সব ধরনের কর্মকাণ্ড এবং সবধরনের মিটিং এবং উপস্থাপনা, তাই এখন স্মাট ফোন, ওয়াইফাই, মোবাইল ডাটা, লেপটপ, ইন্টারনেট ইত্যাদি নিত্যদিনের সঙ্গী। ইন্টারনেটের ব্যবহার গত ছয়মাসে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে, যা ছয় মাস আগেও চিন্তার বাইরে ছিল। আমরা যদি করোনা মহামারির আগের জীবনের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পায় তখন যারা লেপটপ বা জুম নামক জিনিসটি কখনো হাতেই ধরেনি, তারা এখন সারাদিন মিটিং করছে জুমে বা টিমসে। আমরা যদি প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে একই ভাবে এশিয়ার অনেক দেশের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো এশিয়ার অনেক দেশে আর্টিফিশিয়াল ইনিটেলিজেন্স এবং রোবট প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে অনেকগুণ।
দক্ষিণ কোরিয়ায় বিভিন্ন কারখানায় রোবট ব্যবহার অনেকগুণ বাড়ানো হয়েছে, মানে দিন দিন তারা ডিজিটাল প্রযুক্তির দিকে এগুচ্ছে। প্রতি ১০ হাজার কর্মী গড়ে যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদনে সক্ষম, ৭৭৪ টি রোবট একই পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করতে পারে। গাড়ি প্রস্তুত করার দিক থেকে আগে থেকেই জাপান শীর্ষস্থানে। তারা এই শিল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এমন পর্যায়ে ইতিমধ্যেই নিয়ে এসেছে যে অদূর ভবিষ্যতে সেখানে গাড়ি উৎপাদনের কারখানায় মানুষের সরাসরি উপস্থিতি প্রয়োজন হবে না। ডিজিটাল প্রযুক্তি এখন এমনভাবে এগুচ্ছে সামপ্রতিক খবরে দেখলাম আফ্রিকায় যে শিশুরা ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন সুবিধার বাইরে রয়েছে, তাদের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালিত এসএমএস প্ল্যাটফরম তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষামূলক কনটেন্ট সরবরাহ করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারি এ আই প্রযুক্তি উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুযোগও করে দিয়েছে। এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির এই সুযোগ আমাদের ভালভাবে কাজে লাগানোর সময় এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বানানোর স্বপ্ন দেখচ্ছে, এরকম করোনাকালীন সময়ই হলো উওম সময় মানুষকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত করানোর । ১৯৯৫ সালের দিকে এসময়ের প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী যিনি জাপানী বিজ্ঞানী হিসেবে সুপরিচিত ‘মেসিও কাকু ‘তাঁর বিখ্যাত বই ‘ফিজিক্স অব দ্য ফিউচার : দ্য ইনোভেশনস দ্যাট উল ট্রান্সফরম আওয়ার লাইফ’-এ বলেন ‘আগামী ১০০ বছর হবে ডিজিটাল প্রযুক্তির উৎকর্ষের বছর, মানুষ না চাইলেও তাকে ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্বারস্থ হতে হবেই’, যার কথা এখন ২০২০ সালে এসে অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির জনক পল ওটলেট ১৯৩৪ সালেই অন্তর্জাল বা ইন্টারনেট প্রযুক্তির ধারণা দিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত হয়েছিলেন, যিনি তাঁর বিখ্যাত দুটি বই ‘ট্রেটিজ দ্যা ডকুমেন্টেশন (১৯৩৪) এবং ‘ইজি দ্য ইজি দ্যা ইউনিভার্সালিজম (১৯৩৫ ) -এ তথ্য প্রযুক্তির পৃথিবীটা কেমন হবে এবং এক ক্লিকে মানুষ তার সমস্ত তথ্য নিয়ে ব্যবহার করতে পারবে তার খুঁটিনাটির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গিয়েছিলেন অসাধারণভাবে, যার সাহায্যে বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে আধুনিক কম্পিউটার বানিয়েছিল এবং আজকের এই চার্স ইঞ্জিন গুগলের আবিষ্কার হয়েছ। ১৯৩৪-৩৫ সালেই তথ্য প্রযুক্তির জনক বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী পল ওটলেট দেখিয়েছিলেন তাঁর গবেষণায়, মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনধারণের ধরন কীভাবে পাল্টে দেবে এই তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। আজ যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। মানুষ আজ একে অপরের থেকে শারীরিক ভাবে অনেক দূরে থেকেও পরস্পরের কাছে আসতে পারছে অনায়াসে। যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের ফসল আমরা ভোগ করছি নানাভাবে। কোভিড-১৯ এসে এই প্রযুক্তির দৌড়কে আরো বেগবান করেছে। মানুষ এখন পরস্পরের সাথে যোগাযোগের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যত গুলি আবিষ্কার সবই ব্যবহার করছে, সেটা ফেসবুক বলি, টুইটার বা ইন্টাগ্রাম বা ইমো, জুম, টিমস বলি বা অন্যান্য যে কোন ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যমের কথা বলি সবই ব্যবহার করছে, কারণ মানুষ তার প্রয়োজনে একে অপরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কখনো থাকতে পারে নি তাই। যার ফলে যোগাযোগ প্রযুক্তি সেক্টরের এখন রমরমা ব্যবসা এবং আয়ও বেশ রমরমা। ডিজিটাল প্রযুক্তি এখন মানুষের জীবন ধারণের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এই তো আজ থেকে ছয় মাস আগেও ‘জুমের ‘ প্রতিষ্ঠাতা মি: এরিক ইউয়ান ভাবতে পারেননি, তিনি বিশ্বের ৪০০ তম ধনীর তালিকায় থাকবেন, অথচ গেলো মাসের ফোর্বসের শীর্ষ ৪০০ ধনীর তালিকায় ‘এরিক ইউয়ানের নাম জায়গা করে নিয়েছে (প্রথম আলো, ২৫ সেপ্টেম্বর)। বলা হচ্ছে এই কোভিড -১৯ এর কারণে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যতগুলো কোম্পানি আছে তাদের মধ্যে অবিশ্বাস রকমের সমপ্রসারণ ও ভাল অর্থনৈতিক ফল পেয়েছেন জুমের প্রতিষ্ঠাতা ‘এরিক ইউয়ান’। এই কোভিড-১৯ এরিক ইউয়ানের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে । যদিও আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি কিন্তু তার বাস্তব পদক্ষেপ সে তুলনায় তেমন একটা দেখি না। এই করোনা কালে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত খাত হলো শিক্ষা। প্রতিটি শিক্ষক হয়তো নিজেরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন অন লাইন ক্লাস নিয়ে তাদের শিক্ষার্থীদেরকে পড়াশোনায় ব্যস্ত রাখতে কিন্তু তা কি এদেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে সমান ফল দিচ্ছে? অবশ্যই না।
৬৮ হাজার গ্রামের, কৃষি ভিত্তিক ও নদী বিধৌত এ বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে কি এখনো ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছেছে? সত্যিই পৌঁছায় নি। তার মধ্যে আছে লেপটপ বা মোবাইল বা মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধা, তা কি সরকার বা আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি, না পারি নি। তাই বর্তমানের এই অন লাইন ক্লাস গুলো থেকে শহরের শিক্ষার্থীরা যত সুবিধে পাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা ততবেশী বঞ্চিত। কারণ তাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সমস্ত উপকরণ গুলো সঠিক ভাবে নেই । ডিজিটালাইজেশনের এই বাস্তবতায় আমাদের সরকারকেও ভাবতে হবে সারদেশে কীভাবে ঘরে ঘরে ইন্টারনেট সুবিধা স্বল্পমূল্যে দেওয়া যায় এবং ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত সব গুলো পণ্য সামগ্রীর দাম কমিয়ে দিয়ে কোভিড -১৯ মহামারির এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আরো দ্রুত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চলে আসা। তাতে শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমানে যে ক্ষতি হয়েছে তা হয়তো কিছুটা পূরণ করা যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক