পৃথিবীতে মানুষের ‘আনন্দউজ্জ্বল পরমায়ু’ জোগানোর যে বিজয় ইতিহাস রচিত হয়েছে, তার প্রধান নিয়ামক হলো স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত রোগ প্রতিরোধক টিকা। শিশু ও বয়স্কদের টিকাদানের মাধ্যমে প্রায় ২০ টা সংক্রামক মরণব্যাধি থেকে বিশ্বের জনগোষ্ঠী রক্ষা পায়।
ডিসেম্বর ২০১৯, চীনের হুবাই প্রদেশের উহান সিটি হতে সৃষ্ট মারাত্মক সংক্রামক কোভিড-১৯ ভাইরাস জীবাণু বিশ্বে অতিমারী পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। যার ছোবলে লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি ছাড়াও জীবনযাত্রা এবং অর্থনীতির নিরিখে কার্যত বিশ্ব হয়ে পড়েছে স্থবির। এহেন অবস্থায় ভাইরাসের আক্রমণ হতে সুরক্ষা দিয়ে মানবজাতিকে রুখে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে দ্রুততার সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ‘করোনা প্রতিষেধক টিকা’ আবিষ্কার করেন। একটা টিকা প্রায়োগিক স্তরে নিয়ে আসতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। কিন্তু বর্তমানে জীবন সংহারক অতিমারি সামলাতে টিকা তৈরির ক্লিনিকেল ধাপ মোটামুটিভাবে ঠিক রেখে ‘নিরাপদ ও কার্যকর করোনা প্রতিষেধক টিকা’ মানুষের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন মর্ত্যলোকের বিজ্ঞানীরা। করোনা টিকা আবিষ্কারের ফলশ্রুতিতে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের আগেভাগে সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে টিকা সংগ্রহের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় টিকা উৎপাদন ও তার অতিরিক্ত চাহিদা মোতাবেক বিতরণের ফারাক বিশ্ববাজারে টিকার সংকটচিত্র স্পষ্ট করে তুলেছে।
সাথে জনমানুষের মধ্যে যোগ হয়েছে ভ্যাকসিন গ্রহণ করা নিয়ে নানা দোলাচল। ইংরেজিতে যা ‘ভ্যাকসিন হেজিটেন্সি’ বলে উল্লেখ করা চলে। করোনা টিকা আবিষ্কার ঘিরে যে মানবকুল ‘জীবন বাঁচানোর তরী’ হিসাবে আঁকড়ে থাকতে উদগ্রীব ছিল, টিকা প্রয়োগের বাস্তব পরিস্থিতিতে এসে তা নিয়ে হঠাৎ ভর করেছে নানা সংশয়। তবে এর নানাবিধ কারণ আছে, যেমন-
১.প্রথমত তথ্য প্রবাহের অবাধ প্রকাশের যুগে, করোনা ভ্যাকসিন এর আবিষ্কার থেকে শুরু করে ক্লিনিকেল ট্রায়ালের নানা পর্বে কি কি সমস্যা হচ্ছিলো, প্রতিটা উৎসুক মানুষ তা নিয়ে ওয়াহিবহাল থেকেছেন।
২. ফাইজার, মর্ডানা, অ্যাস্টোজেনিকা প্রতিটা টিকা সম্পর্কিত যাবতীয় খুঁটিনাটি যেমন এসবের নিরাপদ মাত্রা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, কার্যকারিতা পৃথিবীবাসী নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
৩. এত দ্রুততম সময়ে ‘করোনা টিকা’ আবিষ্কার এবং তা প্রয়োগের ‘ইমার্জেন্সি অনুমোদন’ ঘিরে টিকা নেওয়া কতটা ঝুঁকিমুক্ত, নিরাপদ ও কার্যকর হবে-তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়া। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা নানা অমূলক কথাবার্তা।
এসব কারণে ‘করোনা টিকা-সোনার হরিণ’ হাতের নাগালে আসার পর তা গ্রহণে অনেকের মাঝে উন্নাসিকতা দেখা দিয়েছে। তথ্যে দেখা যায়, আমেরিকার প্রতি ১০জনে ৪ জন এবং ফ্রান্সে প্রতি ১০ জনে ৬ জন করোনা টিকা গ্রহণে রাজি নন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জনগণের মধ্যে এরূপ অনীহা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা চেতনা অনেক অগ্রসর। গবেষণাচিত্র দেখাচ্ছে, বাংলাদেশে ৮৪ শতাংশ মানুষ টিকাপ্রদানে আগ্রহী। তন্মধ্যে এখনি ৩২ শতাংশ মানুষ ও বাকিরা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ধীরে-সুস্থে টিকা নেওয়ার পরিকল্পনায় আছেন।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো সর্বাধিক করোনা বির্পযস্ত দেশেও টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়নি। কিন্তু করোনার অতি সংক্রামক নতুন বিপজ্জনক সংস্করণ যেমন- বি.১.১৩১, নতুন ঢেউ নিয়ে এসব দেশে আবারো তীব্র হয়ে ওঠার পর দ্রুততম সময়ে বেশিরভাগ নাগরিকদের করোনা টিকা প্রদানের রোড-ম্যাপ বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সংশ্লিষ্ট সরকার। যদিও ইতোমধ্যে বাজারে আসা সব টিকা করোনার নতুন স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে সমভাবে কার্যকর হবে না বলে জানা গেছে। যেমন ফাইজার এর করোনা টিকা যেখানে সদ্য দেখা দেওয়া স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে আফ্রিকায় ৯০ শতাংশ সফল, যুক্তরাজ্যে তার কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে মাত্র ৬২ শতাংশের মতো। তথাপি স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা করোনা রোগ প্রতিরোধে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ জাগ্রত করতে সে অঞ্চলের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে দ্রুততার সাথে টিকা প্রদানের নির্দেশনা দিয়েছেন। সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ‘নতুন জেনারেশনের করোনা টিকা’ উদ্ভাবনের প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন।
কোনো টিকা গ্রহণের পর স্বাভাবিক নিয়মে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যেমন-১.টিকার কারণে- সামান্য জ্বর, টিকা দেওয়ার স্থানে ব্যথা, ফোলা, লাল হয়ে যাওয়া প্রভৃতি। ২. আর কিছু ঝুঁকি তৈরি হয় টিকা প্রদানের পুরো চেইনে কোনো ত্রুটি, টিকা গ্রহীতার মানসিক উদ্বেগ বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া অজানা কোনো কারণে অভাবিত বিপত্তি। একথা সর্বৈব সত্য-এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত কোনো টিকাই শতভাগ কার্যকর ও নিরাপদ না। টিকা প্রদানে দেশের সর্ব্বোচ ‘অনুমোদন সংস্থা’ ও বিজ্ঞানীরা নিজ দেশে করোনা টিকা প্রয়োগের ছাড়পত্র দেয়ার পূর্বে বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই ও তার কার্যকারিতা কমপক্ষে ৫০ শতাংশে সফল- নিশ্চিত হয়েই তা অনুমোদন দেন। এমনকী বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও। বলে রাখা ভালো বাংলাদেশে ‘কোভিশিল্ড’ নামক অ্যাস্টোজেনিকার যে করোনা প্রতিষেধক টিকা আমদানী করা হয়েছে, তা এইসকল মানদন্ডে সন্তোষজনক বলে বিবেচিত।
বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় বিশ্ববাজারে করোনা টিকা প্রাপ্তির আকাল সময়েও বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে দ্বিতীয়দেশ হিসাবে দেশের নাগরিকদের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশব্যাপী টিকাকরণ সফল কর্মসূচি গ্রহণের দোরগোড়ায়। এখন দেশের নাগরিকদের দায়িত্ব-টিকা সম্পর্কিত অপপ্রচারে কান না দিয়ে, আদর্শ নাগরিক হিসাবে টিকা নিবন্ধনের সকল প্রক্রিয়া যথাযথ সম্পন্ন করে করোনা টিকা গ্রহণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা। কেননা পৃথিবীখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী মাতৃভূমি ও বিশ্বকে করোনা সংকট থেকে মুক্ত করার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক একমাত্র সমাধান হলো এই টিকাকরণ।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল