বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্প খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের বিকাশ শিল্পোন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
সরকার দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্যদূরীকরণের হাতিয়ার হিসেবে এসএমইকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে এসএমই আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বৃহৎ শিল্পের তুলনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কম পুঁজিনির্ভর। এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুযোগ বেশি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি শক্তির ব্যবহারও অপেক্ষাকৃত কম এবং পরিবেশ দূষণও কম মাত্রায় হয়। অফুরন্ত সম্ভাবনার আমাদের এ দেশ। আমাদের রয়েছে বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের বিপুল সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
আনন্দের সংবাদ এই যে, সরকার ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পে গতি সঞ্চার এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সমপ্রসারণে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকার আরও দুটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। নতুন দুই প্রণোদনা কর্মসূচির বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, কর্মসূচি দুইটির মোট বরাদ্দ ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যার বাস্তবায়ন অবিলম্বে শুরু হবে। নতুন অনুমোদিত এই দুটিসহ মোট প্রণোদনা প্যাকেজের সংখ্যা হল ২৩টি, যার মোট আর্থিক পরিমাণ এক লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা যা জিডিপির ৪.৪৪ শতাংশ।
গত ১৮ জানুয়ারি দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, নতুন প্রথম প্যাকেজটির আকার এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যার আওতায় ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প খাত এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নেওয়া কার্যক্রম সমপ্রসারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনকে ৩০০ কোটি, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিককে) ১০০ কোটি এবং জয়িতা ফাউন্ডেশনকে ৫০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে এনজিও ফাউন্ডেশনকে ৫০ কোটি, সোসাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনকে ৩০০ কোটি, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনকে ৩০০ কোটি, ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে ১০০ কোটি এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডকে ৩০০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। দ্বিতীয় প্যাকেজের ১২০০ কোটি টাকায় আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ১৫০টি উপজেলায় দরিদ্র্য বয়স্ক এবং বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীর ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, দেশের শিল্প খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের।
অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগের সামাজিক গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতার কথা বলে শেষ করা যায় না। সাধারণ মানুষ তাদের সীমিত মূলধন, সীমিত যন্ত্রপাতি ও অসীম স্বপ্ন নিয়ে এ খাতেই আসেন। তাদের নিকটাত্মীয়-পোষ্য-পরিজনদের বিদেশ থেকে পাঠানো ‘রেমিটেন্সের’ অর্থ বেশিরভাগই ব্যয় হয় এসএমই খাতে বিনিয়োগে। কেননা তাদের সীমিত পুঁজিতে সঞ্চয়ও তেমন জমে না, বড় উদ্যোগের শেয়ার কেনার পথেও বাদ সেধেছে শেয়ারবাজারের অনিশ্চয়তা।
খন্দকার হাসনাত করিম তাঁর এক লেখায় বলেছেন, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও মধ্যম শ্রেণির উদ্যোক্তাদের এখন থেকেই টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে, যার মধ্যে থাকবে কৌশলগত প্রস্তুতি, গবেষণা এবং আজকের পর্যালোচনা থেকে আগামীকালের উপায় অন্বেষণ করা। টিকে থাকার উপায়-কৌশল শুধু করোনাকালের মন্দা মোকাবেলার জন্যই নয়, ভবিষ্যতে এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়া কিংবা এ ধরনের আরও কোনো বিপদ মোকাবেলার জন্যও দরকার।
এখন থেকেই করোনাকালের এবং করোনা-পরবর্তী সংকটের জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। টিকে থাকার মতো যে উদ্যোগই গৃহীত হোক, লাভের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে সামাজিক দায়িত্ব, পরিবেশ রক্ষার ব্যবস্থা এবং মুনাফার সামাজিক সুবিচার বা যোক্তিক বণ্টন নীতিকে; শ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে মেধাকে এবং শিল্প কাঁচামালের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে অব্যাহত গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমকে এবং রক্ষণশীলতা বাদ দিয়ে জেন্ডার সাম্য নীতিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সময় যতই এগোবে, ততই নারীর অবদান এবং উৎপাদনে রমণীয় হিস্যার প্রাসঙ্গিকতা বাড়তে থাকবে। তেমনি তথ্য-প্রযুক্তিসহ যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে, করোনা ও করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ও সর্বাত্মক সদ্ব্যবহার করতে হবে।