বাংলাদেশে করোনার প্রথম ধাক্কা অনেকটা সফলতার সাথে মোকাবিলা করা হয়েছে। এখন হেমন্তের শেষ এবং শীত দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগাম তথ্য অনুযায়ী শীতে দ্বিতীয় ধাক্কায় করোনা বাড়ার সম্ভাবনা বেশী বলে জানা যায়। এর লক্ষণ এখনই দেখা যাচ্ছে। বিগত মাসগুলোর তুলনায় ইদানিং করোনা সংক্রমণের হার অনেকটা বাড়তির দিকে। সরকার ইতিমধ্যে ২য় ধাপ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও প্রদান করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এই ব্যাপারে জনগণকে আগাম সতর্ক বার্তা দিয়েছেন। ২য় ধাপের করোনা মোকাবিলায় বর্তমান চলমান পরিস্থিতির অবনতি হলে জনগণের নিরাপত্তাজনিত কারণে সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হতে পারে, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ঢাকাসহ বাংলাদেশের সর্বত্র ডেঙ্গুর প্রকোপও সমান্তরালভাবে এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
বাংলাদেশে সিডর, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, হাওরের বাঁধ ভাঙা, বন্যা, ফসল হানি ইত্যাদির মত জাতীয় দুর্যোগের আবির্ভাব ঘটলে একশ্রেণীর সুযোগসন্ধানী লোকের ভাগ্য খুলে যায়। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে পুঁজি করে এই সব লুঠেরা নষ্ট রাজনীতির ছত্রছায়ায় সরকারি বরাদ্দের টাকা লুটপাট করে নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলে। মানুষ না খেয়ে মরলেও তাদের কিছু আসে যায় না। যে কোন অবৈধ পন্থা হউক না কেন তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য দুস্থ জনগণের আর্তসামাজিক উন্নয়নের নামে বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দের টাকা পকেটস্থ করতে দ্বিধাবোধ করে না। করোনা মহামারিতেও এদেশের মাটিতে হতদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দের অর্থ ও খাদ্য সামগ্রী লুটপাটের কারণে অনেকের ভাগ্য খুলে গেছে এমন তথ্য প্রচার মাধ্যমে জানা যায়।
করোনা মহামারিতে যেখানে সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে সেখানে নব্য কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত মার্চ হতে জুন এই তিন মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ৩ হাজার ৪১২ জন বেড়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন হতে এ তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আরও জানা যায় ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর পর ব্যাংকে কোটিপতির সংখ্যা কমে গেলেও এখন আবার বেড়েই চলেছে। বিচিত্র আমাদের এই সুজলাসুফলা বাংলাদেশ, যেখানে করোনার মতো জাতীয় মহা দুর্যোগের সময়েও নতুন নতুন ধনীক শ্রেণির উদ্ভব ঘটছে। অপরদিকে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের লোকেরা করোনা মহামারির ছোবলে দিন দিন নিঃস্ব হচ্ছে। নব্য কোটিপতি এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরাট ফারাক সৃষ্টির রেশের ধারা এখনই টেনে ধরার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে দেশে এত উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও ধনী-দরিদ্রের বিরাট এই বৈষম্য জনমনে অসন্তোষ ধীরে ধীরে পুঞ্জিভূত হচ্ছে।
করোনা মহামারির প্রথম ধাক্কা সামাল দিতে সম্মুখ সারির করোনা যোদ্ধা জনপ্রশাসন, আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং কর্তব্যরত চিকিৎসকরা প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন। এযাবৎ করোনা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৭৪জন সদস্য এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৭০ জন চিকিৎসক প্রাণ হারিয়েছেন। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের মতো করোনা যুদ্ধেও মৃত্যুবরণকারীদের জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে। তবে অনেক নামিদামী বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাঙের ছাতার মতো ব্যাপক হারে গড়ে উঠা নাম সর্বস্ব অনুমোদনহীন চিকিৎসা কেন্দ্রের মালিক ও চিকিৎসকরা জাতির এই মহা সংকটকালে মুমূর্ষু করোনা রোগীদের সেবার পরিবর্তে যেভাবে অসৌজন্যমূলক এবং অমানবিক আচরণ করেছে ইতিহাস তাদের কখনো ক্ষমা করবে না। উল্লেখ্য যে, মাইন্ড এন্ড সাইকিয়াট্রিক এন্ড দি এডিকসন হসপিটাল নামে একটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদনহীন মানসিক হাসপাতালে গত ৯ নভেম্বর সকাল ১১টায় ৩১তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের আনিসুল করিম নামে একজন প্রতিশ্রুতিবান উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে (সিনিয়র এ.এস.পি) করোনাকালে মানসিক চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। চিকিৎসার নামে এই হাসপাতালে অমানবিকভাবে শারীরিক নির্যাতনের ফলে ঐদিন বেলা ১১টা ৫০ মিনিটের সময় তাঁর মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং এই মামলায় প্রাথমিকভাবে দায়ী ১১জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চিকিৎসার নামে করোনাকালেও রোগীদের উপর এই হাসপাতালে কিভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয় এর ভিডিও ফুটেজ আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে টেলিভিশনের পর্দায় দেশবাসী দেখতে পেয়েছে।
এবার মাদক প্রসঙ্গে আসা যাক। করোনা মহামারির মধ্যেও আগের তুলনায় মাদক পাচার অনেক বেড়েছে। মাদক পাচার লাভজনক হওয়ায় মৃত্যুঝুঁকি থাকা সত্ত্েও রাতারাতি কোটিপতি হওয়া এর চেয়ে সহজ কোন পন্থা বর্তমান সময়ে এদেশে আছে বলে মনে হয় না। ৬০ এবং ৭০ দশকে সিলেট ও কুমিল্লায় চাকরির সুবাদে দেখেছি তখনকার চোরাচালানিরা সীমান্ত পার করে ভারত থেকে পান, বিড়িপাতা, সুপারি, চোলাই মদ, গাঁজা ও বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রী এদেশে পাচার করে নিয়ে আসতো। এর পরিবর্তে এদেশ থেকে মাছ, চাল, বিদেশী ক্রোকারিজ সামগ্রী ও বিদেশী কাপড়-চোপড় ভারতে পাচার করতো। ৮০ দশক হতে ফেনসিডিল, হিরোইন, মরফিন, গাঁজা এবং অন্যান্য সহজলভ্য মাদক এই স্থান দখল করে। ৯০ দশক পর্যন্ত এদেশে এইসব মাদকের রমরমা ব্যবসা ছিল। ৯০ দশকের শুরুতে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী কঙবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণের পর হতে মিয়ানমার হতে সীমান্ত পার করে ইয়াবা নামক একশ্রেণির সাময়িক যৌন উত্তেজক মাদকের অনুপ্রবেশ এদেশে ধীরে ধীরে শুরু হয়। পরবর্তীতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে আরো ৮ লক্ষ মুসলিম জনগোষ্ঠী উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। এরা আসার পর থেকে বানের পানির মতো বাংলাদেশে সর্বগ্রাসী মাদক ইয়াবা দেদারছে প্রবেশ আরম্ভ হয়। দ্রুত কোটিপতি হওয়ার লোভে টেকনাফ ও উখিয়ার অনেক জনপ্রতিনিধি থেকে আরম্ভ করে সাধারণ মানুষও ইয়াবা পাচারের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার অবাধে যাতায়াত থাকায় এদেশে বর্তমানে তারাই এই মাদকের মুখ্য যোগানদাতা। এই মাদক এখন বাংলাদেশের সর্বত্র অলিতে, গলিতে, রাস্তা-ঘাটে, বাসা-বাড়িতে এমনকি গ্রামের পানের দোকানেও পাওয়া যায়। সহজলভ্যতার কারণে কিশোর, যুবক থেকে শুরু করে মধ্যবয়সীরাও এখন ইয়াবার খরিদদার। বাংলাদেশে এমন কোন বস্তি নাই যেখানে ইয়াবা বিক্রি হয় না। উঠতি বয়সী অনেক বস্তিবাসী নারীও ইয়াবা বিক্রি ও সেবনে পিছিয়ে নেই বলে জানা যায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র ইয়াবা সেবীদের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য শহরের অভিজাত এলাকাতেও এখন ইয়াবা পাওয়া যায়। ইয়াবার কারণে সমাজে এখন ছিনতাই, খুন, ধর্ষণসহ নানা অপরাধের সাথে ইয়াবাসেবীরা জড়িত এমন তথ্যও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে। ইয়াবার কারণে ইদানিং কিশোর অপরাধের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কিশোর অপরাধীরা গ্যাং সৃষ্টি করে সুবিধাভোগী রাজনৈতিক বড়ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নানা অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছে বলে প্রচার মাধ্যমে এও জানা যায়।
মাদক বিস্তার রোধে এখন আর ক্রসফায়ার একমাত্র সমাধান নয়। টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ কর্তৃক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিন্হা হত্যার আগে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের অনেক স্থানে মাদক নির্মূলের নামে ক্রসফায়ারে বহু মানুষ মারা হয়। কিন্তু ইয়াবার আগ্রাসন বন্ধ হয়নি। পাচারকারীরা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত ইয়াবা নিয়ে আসছে। এখন ক্রসফায়ার বন্ধ থাকলেও ইয়াবার আগ্রাসন কমেনি বরং আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইয়াবার আগ্রাসন বন্ধ করতে হলে এই মুহূর্তে জনসচেতনতার বেশি প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। স্কুল- কলেজ, অফিস-আদালত, হাট-বাজারে সর্বত্র ইয়াবা বিরোধী সমাবেশ করে জনগণকে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। ধর্মীয় বিধিনিষেধ সম্পর্কে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সর্বাগ্রে শিশুকিশোরদের পিতা-মাতা ও অভিভাকদের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সুশীল সমাজ, জনপ্রতিনিধি, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে জনপ্রশাসনকেই মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে।
এবার স্বর্ণ চোরাচালান এবং অর্থ পাচার সম্পর্কে আসি। বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক চোরাচালানকারীদের জন্য স্বর্ণ চোরাচালানের সবচেয়ে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আগে পাকিস্তান এবং আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়া ও ঘানার নাগরিকরা স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে বিমানবন্দরে গ্রেফতার হতো। এখন বাংলাদেশীরা এই স্থান দখল করেছে। বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারির যোগসাজশে তারা বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে বিদেশ হতে বিমানে বর্তমানে স্বর্ণ নিয়ে আসে এবং স্থলপথে সীমান্ত পার করে এই স্বর্ণ ভারতে পাচার করে। গত ২১/১১/২০২০ইং তারিখ রাতে ঢাকার মেরুল বাড্ডায় র্যাবের অভিযানে গোল্ডেন মনির নামে একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী ধরা পড়ে। তার বাড়িতে র্যাবের অভিযানের সময় ৮ কেজি স্বর্ণ, এক কোটি নয় লক্ষ টাকা, অস্ত্র ও গুলি এবং বিদেশী মদ পাওয়া যায়। র্যাবের তদন্তে প্রাথমিকভাবে সে স্বর্ণ চোরা কারবারি ও অর্থ পাচারকারীর বলে প্রমাণিত হয়। তার বিরুদ্ধে রজুকৃত মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। সম্প্রতি কুয়েতে গ্রেফতার লক্ষ্মীপুর ২ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য কাজী শহীদুল ইসলাম পাপুল ও তার স্ত্রী সাংসদ সেলিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, মাদক পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের কাহিনী সবার জানা আছে বিধায় আর পুনরাবৃত্তি করা গেল না।
অতিসম্প্রতি কানাডার বেগম পাড়ায় অর্থ পাচারকারী ২৮ জনের তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই ২৮ জনের মধ্যে রাজনীতিবিদদের চেয়ে উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যাই বেশি। সরকার ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেলে সরকারি চাকুরিজীবীদের আকর্ষণীয় বেতন বৃদ্ধি করেছে- যা কল্পনাতীত। বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তাদের চেয়ে এখন সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রক্তস্নাত একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে বসবাস না করে অভিবাসী হয়ে ভিনদেশে বসবাসের জন্য অর্থ পাচার দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ইতিমধ্যে নির্দেশ প্রদান করেছেন। এই মহতী উদ্যোগকে জনগণ স্বাগত জানাচ্ছে। ইতিমধ্যে মহামান্য হাইকোর্ট এদের তালিকা তলব করেছে। এইসব অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ হয়ে যাবে এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
লেখক: কলামিস্ট, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা