প্রথমেই বলে রাখি অনেকেই করোনা শব্দ বোঝে না, করোনা হলো ল্যাটিন শব্দ যার ইংরেজি অর্থ ক্রাউন অর্থাৎ মাথার মুকুট। এটি দেখতে মাথার মুকুটের মত দেখায়। করোনা মহামারি কাল ৬-৭ মাস হতে চলল। জুন -জুলাইর দিকে মানুষ যে ভাবে আতঙ্কগ্রস্ত, ভীতসন্ত্রস্ত ছিল আপাত দৃষ্টিতে ৬০% মানুষের মধ্যে তা নেই। মনে হচ্ছে সব কিছু স্বাভাবিক। জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ ঘরের বাইরে, কিন্তু সার্বিক দৃষ্টিতে করোনা সংক্রমণ আমাদের দেশে রয়ে গেছে। সংক্রমিত মানুষ ঘরে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছে বলে বোঝা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ চলাফেরায় বেপরোয়া। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানতে নারাজ, মানুষের বোঝা উচিত করোনা আক্রমণ কিন্তু নীরবে নিভৃতে। মানুষ টেরই পায় না কখন করোনাভাইরাস তার শরীরে প্রবেশ করল। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়া, বাতাসে ভেসে বেড়ানো এই অদৃশ্য শক্তি যার কাছে কোন প্রকার মারণাস্ত্র নেই সেই শক্তি কী সুন্দর দালান কোটা, গাছপালা না ভেঙেই নিঃশব্দে বিশ্বময় তাণ্ডব চালাচ্ছে। অধ্যাবদি তার আক্রমণ থামছে না। কবে থামবে ভবিষ্যৎ বলতে পারে। তবে এই পরাক্রমশালী যোদ্ধাকে পরাস্থ করার জন্য প্রযুক্তিতে উন্নত কিছু দেশ যেমন চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ভারত প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এই ভাইরাসের প্রতিষেধক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে। চীন, রাশিয়া ভ্যাকসিনের থার্ড ফেইজ ট্রায়ালের জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে এবং সরকার সেটার অনুমোদন দিয়েছে। খুবই মর্মান্তিক এরই মধ্যে বিশ্ব হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ। সংক্রমিত হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ।
এই করোনাকালে মানুষের জীবনধারা বদলে গেছে। সর্বস্তরের মানুষ কী গরীব কী ধনী তার চিরাচরিত জীবনধারা অনেকটা বদলাতে বাধ্য হয়েছে। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে কেউ কারো কাছে ঘেঁষে না। ৬ ফুট ফিজিক্যাল দূরত্ব বজায় রাখছে। পরিচিত বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হলে হাত মিলায় না, আপনজনকে অনেকদিন পর দেখা হলে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে না। সন্তানকে কোলে নেয় না, অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বাহির হয় না। ঘর থেকে বাহির হলে নাকে মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যে লোক কোন দিন শরীর চর্চা করেনি তাকে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হচ্ছে। পুষ্টিকর খাদ্য খেতে হচ্ছে। টিভি সেটের সামনে বসে যারা খবর, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি দেখত তারা দেখতে চায় করোনা সংক্রান্ত আপডেট, করোনা সংক্রমণ কমে গেছে কিনা, মৃত্যু সংখ্যা কত, কোন ওষুধ ভাল কাজ করে, কী কী সাবধানতা অবলম্বন করলে সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকা যায় ইত্যাদি। করোনায় বদলে গেছে বিপুল সংখ্যক পড়ুয়া সমাজের শিক্ষাজীবন। সব শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের নিত্যদিনের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আজ প্রায় সাতমাস ধরে বন্ধ রয়েছে এবং কবে শুরু হবে বলা মুশকিল। মায়েরা খুব ভোরে তাদের শিশুদের ঘুম থেকে উঠায় না, তাদের মুখে টিফিন তুলে দেয় না। চঞ্চল শিশু ও পিতামাতার মনে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙার উপক্রম, পরিবারে একটা অশান্ত পরিবেশ। আবার কারও কারও শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা দেখে দিচ্ছে। তবে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে। যাদের অনলাইনের সুযোগ নেই তারা কী করছে? এটাও ভাবতে হবে। সরকার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় এস.এস.সি, এইচ.এস.সি পরীক্ষার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অপেক্ষায় আছে। ছাত্র জীবনের এই মূল্যবান সময় আজ বাধাগ্রস্ত।
বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বের গরীব, উন্নত ও সম্পদশালী সব দেশে এই অতিমহামারিতে অর্থনীতির চাকা বদলে গেছে। ২১৩টা করোনা আক্রান্ত দেশ পর্যুদস্ত অর্থনীতির সংকট কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। তারমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ কর্মী যারা মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করত তাদের কয়েক লক্ষ লোক চাকরিচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে আসছে এবং আরও আসার অপেক্ষায় আছে। সরকার তাদের ভরণ পোষণের কথা ভাবছে। দেশে এই কয়েকমাসে ব্যবসাচ্যুতদের সংখ্যা বেড়েছে। একদিকে বাজারে ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে সব জিনিসের দাম যেমন প্রতিদিন বাড়ছে তেমনি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে আসছে। স্বল্প পুঁজি ও ছোট খাট ব্যবসায়ীরা পথে বসার উপক্রম। ব্যবসা চলছে না বিধায় নিজ ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসা ধরছে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। হাজার হাজার লোক যারা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করত তাদের অনেকেরই চাকরি নেই, আর যাদের আছে তাদের বেতন কমে গেছে। যারা দিন মজুর, যারা ছোট খাট ব্যবসা বা চাকরি করে সংসার চালাত তাদের অনেকেই ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। একমাত্র গার্মেন্টস শিল্পছাড়া রোজগারের অন্যপথ থমকে গেছে। বদলে গেছে জীবনের সম্ভাবনার ধার, ধর্মীয় ও বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম অতিক্ষুদ্র পরিসরে সারানো হচ্ছে যাতে করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এই অতিমহামারির মধ্যে সমাজের কিছু সুযোগ সন্ধানী দুর্নীতিবাজ লোকদের চরিত্র আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে। এই করোনা মহামারিতে লকডাউন কালে প্রকৃতি একেবারে বদলে গিয়েছিল। প্রকৃতির দিকে তাকালে একেবারে ভিন্নরূপ। প্রকৃতি তার নিজস্ব রূপ ফিরে পেয়েছিল। তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত রূপ ধারণ করেছে। কারণ প্রকৃতির সর্বত্রই এই কয়মাস মানুষের পদচারণা, নিষ্ঠুর আচরণের প্রভাব পড়েনি। সে ফিরে পেয়েছে তার সজীবতা, ফিরে পেয়েছে নতুন নতুন ডাল পালা গজিয়ে বেড়ে উঠার সুযোগ। বৃক্ষ রাজি ফুলে ফলে ভড়ে উঠেছে, বুক ভরে শ্বাস নিল এ কয়টি মাস। সমুদ্রের ঘোলাজল নীল বর্ণ ধারণ করল। এ সময় সমুদ্রের কচ্ছপেরা রাতের আধারে সৈকতের বালিয়ারিতে তৈরি বাসায় এসে ডিম পেড়ে আবার সাগরে ফিরে গেল। শহর ও নগরীর রাস্তাঘাট সুনসান ও পরিষ্কার ছিল।
করোনা বিশ্ববাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে কেমন বৈরী আচরণ করে সভ্যতার পথে হাঁটছে মানুষ। তাই বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন প্রকৃতির সাথে বৈরীতা নয়। যে উহান শহরে করোনা মহামারির উৎপত্তি সেখানে বিক্রি হয় বাদুর, বন্যপ্রাণীর মাংস, সামুদ্রিক প্রাণী ও মাছ প্রভৃতি। চাইনিজরা এগুলো ভক্ষণ করে। আশঙ্কা করা হচ্ছে এই বন্যপ্রাণী ও অনেক সামুদ্রিক প্রাণীর শরীর থেকে করোনাভাইরাস মানব শরীরে প্রবেশ করেছে। কারণ আমাদের চারপাশে এমন অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে যারা এই পরজীবী ভাইরাস বহন করে। প্রকৃতি-গবেষক ও সংরক্ষণবিদ এনরিক সালাও মনে করেন প্রকৃতিকে রক্ষা করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এখনই সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে আরও অনেক রোগ বালাই মহমারি পৃথিবীতে আসবে। পরিশেষে একমাত্র আত্মসচেতনতা দিতে পারে করোনা মুক্ত জীবন।
লেখক : প্রাক্তন চিফ এনাসথেসিওলজিস্ট,
বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।