বাংলাদেশের প্রখ্যাত ভাইরাস অণুজীবাণু বিজ্ঞানী, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক ডা. নজরুল স্যার এক সাক্ষাৎকারে জানালেন- ‘ভাইরাস আটকিয়ে রাখা যায় না, তবে কিছু সময় পাওয়া যেতে পারে’। বাংলাদেশ মানচিত্রের পাশে থাকা ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার যখন ডেঙ্গু মহামারিতে ছয়লাব হয়ে রোগের কালো বিন্দু চিহ্নিত, অনেক মাস-বছর ধরে মাঝখানে থেকেও একমাত্র বাংলাদেশ সাদা স্পট হিসাবে টিকেছিল, কিন্তু ঠিকই বাংালাদেশেও ডেঙ্গু মহামারি দেখা দেয়। এই ইতিহাস ও করোনা অতিমারি বিশ্বচিত্র দেখে তাঁর উক্তির যর্থার্থতা মেলে।
আন্তঃরাষ্ট্রীয় নানা সতর্কতা ও বিধিনিষেধ জারি সত্ত্বেও করোনার ইউ.কে, আফ্রিকান ও ব্রাজিলিয়ান প্রভৃতি নতুন রূপান্তর যেন চোখের পলকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঢুকে পড়ছে, যেভাবে ভারতে পৌঁছে নতুন ধরন নিয়ে বাতাসে ৮ ঘন্টার মতো ভেসে থেকে অধিক সংক্রামক ও বলশালী হয়েছে। ইতোমধ্যে শ্রীলংকায় নতুন এক ধরন শনাক্ত হয়েছে, যা বাতাসে ২৪ ঘন থেকে বায়ুপ্রবাহে ২০ ফুট দূরত্বে পৌঁছে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম। সত্যিকার অর্থে এই জীবাণু কোনো দেশ, ধর্ম, বয়স, লিঙ্গ সীমানায় আবদ্ধ নেই।
সর্বশেষ সংবাদে জানা গেল, বাংলাদেশেও ভারতের নতুন ধরন বি.১.৬১৭.২ শনাক্ত হয়েছে। করোনার এটা এক ভয়ংকর রূপান্তর, ইতোমধ্যে বিশ্বের ৪৪ টা দেশে এর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। পুরানো স্ট্রেইনগুলোতে প্রধানত আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ উর্ধ্ব মানুষেরা। নতুন স্ট্্েরইনগুলো শিশু-কিশোর, অনুর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সে প্রচুর সংখ্যায় সংক্রমণ ও মৃত্যু ঘটাচ্ছে। তবে এর কারণ হিসেবে দ্বিতীয় ঢেউতে তুলনামূলকভাবে বয়স্কদের বাড়ির বাইরে কম বের হওয়া ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা তৈরি হওয়া, অন্যদিকে কম বয়সীদের বেপরোয়া আচরণও অধিক দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
বাতাসে বেশিক্ষণ থাকার কারণে কেউ একজন যদি মাস্ক না পরার কারণে করোনা জীবাণু হাঁচি-কাশির মাধ্যমে কোনো রেস্টুরেন্টে বা শপিং মলে সকালে ছড়িয়ে দেয়, তবে মাস্কহীন বিকেলে ওইস্থানে যাওয়া অন্য কেউ তা ঘরে নিয়ে ঢুকতে পারেন। এজন্য ঘরের বাইরে বেরোলেই ‘সঠিক পদ্ধতিতে মাস্ক, মাস্ক, মাস্ক’ পরার বহুল প্রচারিত নির্দেশনা। এ কথা জেনে রাখা ভালো, ডিসপোজেবল সার্জিক্যেল মাস্ক স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়া সাধারণ ব্যবহারে বেশ কার্যকর, তবে তা একনাগাড়ে কেবল ৮ ঘন্টা ও একবার মাত্র ব্যবহার করা যায়।
করোনার নতুন ধরনে রোগ উপসর্গও বদলে গেছে। ‘করোনা টেস্ট নেগেটিভ’ বহু রোগী হঠাৎ তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে আইসিইউ কেয়ারে ভর্তি হচ্ছে, যেখানে আগের পরীক্ষিত ওষুধ তেমন সুফল দিচ্ছে না। শিশু-কিশোরদের আক্রানত অনেকে প্রায় উপসর্গহীন থেকে, সপ্তাহ তিনেক পরে জ্বর ও সারা শরীরে র্যাশ-সহ এমআইএস-সি (মাল্টিপল ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম-কোভিড) রোগ জটিলতা নিয়ে হাজির হচ্ছে।
বিপুল মৃত্যু, শিক্ষা ও অর্থনীতির তাৎক্ষণিক ক্ষতি ছাড়াও করোনা থেকে আপাত সেরে ওঠা বিশাল সংখ্যক রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান যে কোনো দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয়। ব্রিটেনের চীফ মেডিকেল অফিসার ডা. ক্রিস হুইটির মতে তাঁর দেশে ‘লঙ্ কোভিড’ ফলো আপ ক্লিনিক রোগীর সংখ্যার তুলনায় যথেষ্ট অপ্রতুল। প্রকৃতপক্ষে মস্তিষ্ক, হার্ট,ও নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোভিড জটিলতার চিকিৎসা পরিষেবা খুবই জরুরি। তার সাথে কোভিডকালে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘মারাত্মক বিষন্নতা’ অসুখের প্রাবল্য- বিশেষত মহিলা ও কিশোর-বয়ঃসন্ধিকালে বেশ উদ্বেগজনক হারে বিরাজ করছে বলে গবেষণায় প্রতীয়মান।
দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় ‘ত্রাহি ত্রাহি রব’ ওঠা ভারতের এপিডিমিওলজিস্টগণ নভেম্বরের শেষে বা ডিসেম্বরের প্রথম নাগাদ তৃতীয় ঢেউ আসবে বলে ‘লাল সংকেত’ দিয়েছেন। প্রতিবেশি দেশে এইরকম বিপজ্জনক করোনা পরিস্থিতি আমাদের জন্য চরম উদ্বেগজনক। নতুন নতুন স্ট্রেইন অধিক সংক্রামক ও প্রাণঘাতী হয়ে থাকে। ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ হতে যেখানে প্রথম ঢেউতে মৃত্যু ছিল দেড় কোটি, দ্বিতীয় ঢেউতে তা হয়ে দাড়িয়েছিল প্রায় পাঁচ কোটি। করোনা প্রতিহত করার প্রধান ঢাল টিকা, টিকা, টিকা। দূরদর্শিতা দেখিয়ে যার সুফল পেয়েছে ইসরাইল ও আরব আমীরাত। যুক্তরাজ্য ৫০ উর্ধ্ব বয়সীদের জন্য তৃতীয় ডোজ টিকাকরণ শুরু করার পথে। ভারতীয় ও আফ্রিকান রূপান্তর, ইয়োরোপ-কেন্ট স্ট্রেইনের তুলনায় বেশি টিকা প্রতিরোধী বলেও বিবেচিত হচ্ছে। তবে নতুন স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে অধিক কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরিতে মরীয়া টিকা বিজ্ঞানীরা।
তারচেয়েও বড় কথা সারা পৃথিবীতে দ্রুততম সময়ে সকল জনগোষ্ঠীর জন্য সমতাভিত্তিক টিকাকরণ করা গেলে করোনা নতুন নতুন দেশে গিয়ে নতুন রূপান্তর ঘটাতে পারতো না। এই বোধোদয়ের পর এবার মজুদ করে রাখা টিকা যুক্তরাষ্ট্র (প্রায় ৬ কোটি ডোজ অঙফোর্ড ভ্যাকসিন ), ফ্রান্স ( নিজ দেশের ৫ শতাংশ ভ্যাকসিন ) উন্ন্য়নশীল দেশে ছাড় দেবার কথা বিবেচনা করছে, এমনকী ব্রিটেনকে মজুদকৃত টিকার ২০-২৫ শতাংশ এভাবে বিতরণে আহ্বান জানিয়েছে।
সুতরাং দেশে বিপজ্জনক করোনা রুপান্তর নতুন ঢেউ নিয়ে আছড়ে পড়ার আগে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি-প্রতিরোধ পরিকল্পনা দরকার, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. দেশের খ্যাতনামা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মাজহারুল স্যারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী স্বপ্লতম সময়ে শিক্ষার্থী-সহ দেশের ১২ থেকে ১৩ কোটি মানুষের দ্রুত টিকাকরণ বাস্তবায়ন কৌশল। ২. ঢেউ সামলাতে শয্যাসংখ্যা, অঙিজেন, ওষুধ এর মজুদ নিশ্চিত করা। ৩. কোভিড ফলো-আপ ক্লিনিক চালু।
ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো অনেক সুদৃঢ়। তবুও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ বিশ্বে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশের প্রতিটা নাগরিককে বুঝতে হবে-সর্বদা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সর্বক্ষণ পুলিশ লাগানো কিংবা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যাওয়া সরকারের একার কাজ না, সম্ভবও না। এমনিতে বাঙালি উৎসবপ্রবণ জাতি। সমুদ্র সৈকত বিহার, বনভোজন, বিয়ে-শাদী-শপিং এর আঁচ পেলে অনেককে যেন কোমরে দড়ি বেঁধেও রাখা যায় না।
বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্ব ও সার্বক্ষণিক তত্বাবধানে,এতটা সময় বাংলাদেশ প্রশংসনীয়ভাবে করোনা মোকাবিলা করতে সমর্থ হয়েছে। তবে এর সঙ্গে নিজের সুরক্ষা, নিজ পরিবার, সমাজ, দেশকে এই মারণ ব্যাধির হাত থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে-সঠিক নিয়মে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় ও হ্যান্ড হাইজিন কঠোরভাবে পালন করা প্রত্যেক নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব-কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে থাকা চলবে না।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।