বাংলাদেশ খাদ্যপণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ। অনেক আগে থেকে আমরা এই দাবি করে আসছি। কিন্তু তারপরও অনেক পণ্য আমদানির ওপর নির্ভর করে এগুলোর প্রাপ্যতা। চাল, গম, ডাল থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। আমদানির পরও যে তা দামের ওপরে সব সময় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, সে কথাও বলা যাচ্ছে না। পত্রিকান্তরে বলা হয়েছে, ‘সমপ্রতি পেঁয়াজের বেলায় সে রকমই দেখা গেছে। আমদানির পেঁয়াজ বাজারে আসার পরও দাম কমেছে সামান্যই। চিনি ও ভোজ্যতেলের বেলায়ও একই রকম প্রবণতা দেখা গেছে। এখন সর্বসমপ্রতি যুক্ত হলো সবজি হিসেবে গণ্য হওয়া কাঁচা মরিচ ও টমেটো। এর আগে কখনো কাঁচা মরিচ ও টমেটোর ঘাটতির কথা শোনা যায়নি এবং হাজার হাজার টন পরিমাণে তা আমদানির প্রয়োজনও হয়নি।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত ‘বৈদেশিক বাণিজ্য পরিসংখ্যান’ শীর্ষক বার্ষিক প্রকাশনায় দেখা যায়, ২০২০–২১ সালে বাংলাদেশের মোট আমদানি মূল্য ছিল ৭৮ হাজার ২১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। উক্ত অর্থবছরে বাংলাদেশে আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিসহ যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, পেট্রোলিয়াম পণ্য, কাঁচা তুলা, লোহা ও ইস্পাত, প্লাস্টিকসামগ্রী ইত্যাদি। অন্যদিকে, ২০২০–২১ সালে রপ্তানির মোট মূল্য ছিল ৪১ হাজার ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০১৯–২০ সালের তুলনায় ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তৈরি পোশাক, বিশেষ বোনা কাপড়, কাঁচা চামড়া, জুতা, তৈরি টেক্সটাইল সামগ্রী বাবদ রপ্তানি বেড়েছে।
চট্টগ্রাম, মোংলাসহ ২৯টি কাস্টমস ও শুল্ক স্টেশনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২০২১–২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৭৮৭ কোটি ডলার। তার আগের অর্থবছরের এসব স্টেশন দিয়ে পণ্য আমদানি ব্যয় ছিল ৬ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে পণ্য আমদানিতে ব্যয় ৩৩ শতাংশ বা ২ হাজার ২৩২ কোটি ডলার বাড়তি ব্যয় হয়েছে। এসব শুল্ক স্টেশন দিয়ে ৯৮ শতাংশ পণ্য আমদানি হয়। তবে আমদানি ব্যয় বাড়লেও পরিমাণের দিক থেকে সার্বিকভাবে আমদানি কমেছে। রাজস্ব বোর্ডের প্রাথমিক হিসাবে, ২০২১–২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানি হয়েছে ১৩ কোটি ৯৪ লাখ টন। ২০২০–২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪ কোটি ৫০ লাখ। অর্থাৎ পণ্য আমদানি ৫৬ লাখ টন বা ৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ কমেছে। পরিমাণ ও আমদানি ব্যয়ের তুলনা করে দেখা গেছে, কোনো কোনো পণ্যের আমদানি কমলেও ব্যয় বেড়েছে। আবার অনেক পণ্যে আমদানি যেমন বেড়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে ব্যয়ও বেড়েছে। যেমন সিমেন্টশিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকারের আমদানি কমলেও ব্যয় বেড়েছে। একই অবস্থা গম, সয়াবিন বীজ, অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রেও। আবার পুরোনো লোহার টুকরো, তুলা, এলপিজি, সার, পাম তেলের মতো পণ্যের আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ব্যয়ও বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আমদানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন। তাঁরা বলেন, আমদানি হ্রাসে, আমদানিতে নিয়ন্ত্রণের ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভালো ফল হয়। স্বনির্ভরতা আসে। আত্মনির্ভরশীলতা ফিরে আসে। সরকার যদি আমদানিতে কঠোর থাকেন, তাদের ভূমিকার কারণে এবং বর্তমান কঠোর আমদানি নীতির ফলে আমরা কিছুটা ভালো ফল পাব। ডলার সাশ্রয় এক কথা, বিপরীতে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি বৃদ্ধির ঘটনা অর্থনীতিবিদদের কিছুটা হতাশ করছে। অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. আর এম দেবনাথ বলেন, আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে। একটি খবরে দেখলাম, গড়ে বছরে আমাদের রফতানি হচ্ছে জিডিপির ১২ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং আমদানির পরিমাণ ১৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আমদানি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছানোর পেছনে ‘ওভার–ইনভয়েসিং’ দায়ী বলে সবাই মনে করেন। সমপ্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকও তা স্বীকার করেছে। এখন আমদানি ঋণপত্র তদারকি করা হচ্ছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, রফতানি রফতানি বলে আমরা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছি। এমন অবস্থায় চাল, গম, চিনি, তেল, আটা, রসুন, ডাল পেঁয়াজ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিপত্রের জন্য আমরাও আমদানিনির্ভর। এমন অবস্থায় সমগ্র আমদানি বাণিজ্যের পর্যালোচনা দরকার। কতটুকু প্রয়োজনের আমদানি আর কতটুকু অপ্রয়োজনীয় আমদানি। সবচেয়ে বড় কথা ওভার–ইনভয়েসিংয়ের ফলে কত বিলিয়ন ডলার পাচার হয় তাও দেখা দরকার।
সমপ্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার দেশভিত্তিক পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমরা আছি শীর্ষ দশে। কৃষিপণ্য উৎপাদনের যে খবর পাওয়া যায়, তাতে মনে হয় না পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কিন্তু আমরা তো উন্নতির খবরই পেতে চাই। আমরা চাই, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিতে। জোর দিতে হবে উৎপাদনে।