কমছে মিঠা পানির জলাশয়, নামছে ভূ-গর্ভস্থ পানীয় জলের স্তর

বিশ্ব জলাভূমি দিবস আজ

আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার | শুক্রবার , ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধির কারণে ঘটছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। এর ফলে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে জলবায়ু। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, ঝড়ঝঞ্ছা। কৃষি জমিগুলো হারাচ্ছে জলধারণের ক্ষমতা। সেই সাথে কমছে মিঠা পানির জলাভূমি। এরফলে শুষ্ক মৌসুমে কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানীয় জলের স্তরে ঘটছে লবণ পানির অনুপ্রবেশ, পানীয় জলের জন্য তৈরি হচ্ছে হাহাকার। কিন্তু বেশি বেশি মিঠা পানির জলাভূমি তৈরির মাধ্যমে এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন পরিবেশ প্রকৌশলীরা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী বলেন, পরিবেশবিদ্যায় জলাভূমিকে কার্বন সিঙ্ক বা কার্বন শোষক, দূষণ ফিল্টার, বন্যা নিয়ন্ত্রক, বন্যজীবন নার্সারি, উর্বর খামার জমি এবং ঝড় ও বাতাস প্রতিরোধক হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুতন্ত্রে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। জলাভূমি মাটির উপরে বৈচিত্র্যময় প্রাণের সমাবেশ ঘটায়। মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে, মাটির নিচের আদর্শ রসায়ন ও ভূগর্ভস্থ পানীয় জলের মজুদ ঠিক রাখতে সহায়তা করে জলাভূমি। বিনোদন ও পর্যটনের জন্যও জলাভূমির গুরুত্ব অতুলনীয়।

ইকোসিস্টেমস’ বা বাস্তুতন্ত্র হল উদ্ভিদ, প্রাণী, মাটি, পানি এবং অণুজীবগুলি যেখানে একসাথে বসবাস করে এবং অস্তিত্বের জন্য একে অপরের উপর নির্ভর করে। বাস্তুতন্ত্র বন্য গাছপালা এবং প্রাণীদের বাসস্থান সরবরাহ করে, বিভিন্ন ফুড চেইন ও খাবারের ওয়েবগুলিকে ঠিক রাখে, প্রয়োজনীয় পরিবেশগত প্রক্রিয়া ও জীবন ধারণকে নিয়ন্ত্রণ করে। জৈব ও জৈব উপাদানগুলির মধ্যে পুষ্টি পুনর্ব্যবহারের সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। বাস্তুতন্ত্র জলচক্র, কার্বন চক্র, অক্সিজেন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র ও শক্তি চক্রসহ একই বাস্তুতন্ত্রের শক্তির যথাযথ প্রবাহ বজায় রাখে। আর পৃথিবীতে কয়েক লক্ষ স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। একটি পুকুর বা কুয়াকে কেন্দ্র করেও স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠতে পারে। তবে পৃথিবীতে মূলত ৬ ধরনের বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। এগুলো হল বনভূমি, তৃণভূমি, মরুভূমি, মিঠা পানি ও সামুদ্রিক পানির জলাধার এবং আর্কটিক তুন্দ্রা। আর এই বাস্তুতন্ত্রের ‘প্রাণ’ হল জলাভূমি।

মাত্র তিন যুগ আগেও কক্সবাজার শহরে মিঠা পানির জলাভূমি ছিল ২৭% এর বেশি। এখন জলাভূমি আছে ৫% এর কম। প্রায় একই অবস্থা কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় গ্রামাঞ্চলগুলোতেও। কিন্তু কক্সবাজারে এভাবে মিঠা পানির জলাভূমি কমে যাওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে এবং মিঠা পানির স্তরে মানবদেহে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত লবণ ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে জানান পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।

এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে কক্সবাজার শহরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বা ২৯.৫৮ ভাগ এলাকা ছিল লতাগুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ আচ্ছাদিত। আর দ্বিতীয় স্থানে ছিল জলাশয়, যা শহরের ২৭.২৯ ভাগ এলাকা। ওই সময় শহরের মাত্র ১২.৬৯ ভাগ এলাকায় ঘরবাড়ি ছিল, আর ৯.৯ ভাগ এলাকায় ছিল বালিয়াড়ি। এছাড়া শহরে বন ছিল ৬.৪৪ ভাগ এলাকায় এবং কৃষি জমি ছিল ১২.৮৯ ভাগ। কিন্তু মাত্র ২১ বছরের ব্যবধানে ২০১০ সালের জরিপে জনবসতি বেড়ে দাঁড়ায় ৩১.৩৯ ভাগে, লতাগুল্মঝোঁপঝাড় কমে দাঁড়ায় ২৩.৬০ ভাগ, জলাশয় ১৭.৩১ ভাগ, কৃষি জমি ৯.৯২ ভাগ, বালিয়াড়ি ২.২৭ ভাগ, বন ৫ ভাগ এবং আর্দ্র জমি ৫.৩০ ভাগ। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে ভূমির ব্যবহার আরো ব্যাপক মাত্রায় পরিবর্তিত হয়েছে বলে মনে করেন জরিপকারী গবেষক দলের প্রধান ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী। তিনি মনে করেন, গত ১০ বছরে শহরে জনবসতির হার আরো অনেক বেড়েছে, কমে গেছে জলাশয়, বন, কৃষিজমি, লতাগুল্ম ও বালিয়াড়ি। বর্তমানে শহরে ৫ ভাগ মিঠা পানির জলাশয়ও আছে কীনা সন্দেহ।

গত তিন দশকে কক্সবাজারে ভূমির ব্যবহারে ব্যাপকমাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। মিঠা পানির জলাভূমি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানীয় জলের জলাধারের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর ব্যাপকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে এবং মিঠা পানির স্তরে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত লবণ ও ইউরেনিয়ামথোরিয়ামের মতো ক্ষতিকর পদার্থের অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে মনে করেন জরিপকারী গবেষক দলের প্রধান।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশবিজ্ঞানী ড. আনছারুল করিম বলেন, মাত্র তিন দশক আগেও কক্সবাজার শহরসহ জেলাজুড়ে মাত্র ১০ থেকে ২৫ ফুট গভীরে নলকূপ বসিয়েই সারা বছর সুপেয় মিষ্টি পানি পাওয়া যেত। এমনকি কিছু কিছু এলাকায় অগভীর নলকূপ থেকেই ঝর্ণার মতো অনবরত পানি বের হতো। আর এখন সুপেয় পানির জন্য কোনো কোনো এলাকায় যেতে হয় ৮শ ফুটের বেশি গভীরে।

এর পাশাপাশি কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকার কৃষি জমিগুলো বহুবর্ষজীবী জল ধারণের ক্ষমতা হারিয়েছে। কক্সবাজার পরিবেশগতভাবে এখন ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। প্রধানত মিঠা পানির জলাভূমি কমে যাওয়ার কারণেই এই সমস্যা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, পরিবেশের উপর এই ধ্বংসযজ্ঞ না থামালে এবং হারিয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা না হলে খুব শীঘ্রই কক্সবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কৃষি জমিগুলোর বহুবর্ষজীবী জলধারণের ক্ষমতা ও ভূগর্ভস্থ পানীয় জলের স্তর পুনরুদ্ধার এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্বন শোষক হিসাবে বেশি বেশি মিঠা পানির জলাভূমি তৈরির মাধ্যমে এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতি মাসে একজন বিচারপ্রার্থীকে বিনামূল্যে আইনি সেবা দিন
পরবর্তী নিবন্ধঅ্যাডভোকেট নুরুচ্ছফা তালুকদারের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ