কবি মুদাসসীর আলীর দুটি অসাধারণ সৃষ্টি

ইকবাল হায়দার | মঙ্গলবার , ১২ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৮ ইংরেজি সনের কথা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের উপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম থেকে, চট্টগ্রামের শিল্পী নিয়ে, প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশন ঢাকায় ‘মাটির সুবাস’ শীর্ষক অনুষ্ঠান যা নওয়াজীশ আলী খানের প্রযোজনায় ও শহীদুল ইসলামের উপস্থাপনায় বর্ণালী অনুষ্ঠানে পরিবেশনের জন্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শিল্পী শেফালী ঘোষের স্বামী সংগীতজ্ঞ বাবু ননী গোপাল দত্তকে সার্বিক তত্ত্বাবধানসহ অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও সাজানোর দায়িত্ব দেন ঢাকা টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ।

সেই সুবাদে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রেম, বিচ্ছেদ ও আঞ্চলিকতা নির্ভর প্রচলিত সংগীত নির্বাচন, প্রয়োজনে রচনা, সংশ্লিষ্ট গানের নামিদামি গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, অভিনেতা, অভিনেত্রী সংগ্রহ এবং মহড়ার নিমিত্তে শেফালী দি’র বাসা নন্দনকানন ১ নং লেন, এন এন পাল বিল্ডিংয়ের নিচতলার বাসায় চট্টগ্রামের বেতার ও মঞ্চের পরিচিত শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানান বাবু ননী গোপাল দত্ত। তৎমধ্যে গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ছিলেন কবি মুদাসসীর আলী, আব্দুল গফুর হালি, লক্ষ্মীপদ আচার্য, এম এন আকতার, মোঃ চাঁন মিয়া (বেতারের বেহালা বাদক) ও সনজিত আচার্য।

কণ্ঠশিল্পী ছিলেন আব্দুর রহিম, সাইফুদ্দিন মাহমুদ খান, ইকবাল হায়দার, মোঃ মুস্তাফা কামাল, বাণীকুমার চৌধুরী, ওয়াহিদুর রহমান, কান্তা নন্দী, মাসরেকা সুলতানা, নীলুফার খানম, সৈয়দা রুনা পারভীন, রুহিতা খানম, নাছিম হায়দার, তৃষ্ণা চৌধুরী এবং নৃত্যে অঞ্জু ঘোষ ( অঞ্জলি ঘোষ), শুভ্রা সেন গুপ্তা ও শুভ্রা সাহা।

প্রথানুযায়ী সবার সাথে পরিচয় ভাব বিনিময়ের পর ননী বাবু এক কোণায় বসে থাকা একজন বৃদ্ধ বয়সী মুরুব্বির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। (বয়সের স্পষ্ট ছাপ অবয়বে, মুখে পান, বাবড়ী কাটা চুলে ঘাড় ঢাকা, মাথায় ভারী টুপি, পাঞ্জাবির উপরে শেরোয়ানী )। ননী বাবু বলেন, ইনি হলেন সবার মুরুব্বি কবি মুদাসসীর আলী, বেতারের একজন গীতিকার, ওনি সেই বিখ্যাত কালজয়ী গান ‘আমার প্রেমের জগতে তুমি হবে মমতাজ আমি শাজাহান’ গানের রচয়িতা। টেলিভিশনে যে সমবেত গানটি পরিবেশিত হবে তিনি গানটি রচনা করেছেন এটি বারো আউলিয়ার গান’। (যা ছিল দীর্ঘ ৬০ লাইন লম্বা যা পরবর্তীতে সাধু ভাষায় লিখিত গানটি)। আমি, আব্দুর রহিম, সনজিত আচার্য, সাইফুদ্দিন মাহমুদ খান ও মোঃ চান মিয়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বিখ্যাত বারটি কালজয়ী গানের সুরের আদলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তরিত করে ঐ অনুষ্ঠানে সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করি)

সেই সত্তর দশকের কথা, সন, তারিখ ,ক্ষণ, কিছুই মনে থাকার নয়। চট্টগ্রাম বেতার থেকে সকাল আনুমানিক দশটার পরে ঘোষণা আসল এখন আধুনিক গান পরিবেশন করবেন শিল্পী মোহাম্মদ হারিছ উদ্দিন আহমদ, গীতিকারমুদাসসীর আলী।

বেতারে বেজে ওঠে,

আমার প্রেমের জগতে

তুমি হবে মমতাজ

আমি শাজাহান

সোনালী স্বপন হেরিয়া জাগিবে

পাপিয়ার কলতান।

তোমার বীণায় মোর গান খানি

আপনা হারিয়ে বাজিবে গো জানি

সাত সুর আর সাত রঙ ধরে

এক হবে দুটি প্রাণ।

কারো কারো মালা দেব গলে তব

সাজাব রাণীর বেশে

চাঁদ জাগা রাতে বেড়াব দুজনে

মেঘ মেরুর দেশে

আবার মানুষ যমুনা তীরে

কুসুম কমল হয়ে থেকো ঘিরে

রচে যাব সেথায় তাজমহল

বেলা হলে অবসান।

কী নান্দনিক কথায়, শব্দের গাঁথুনিতে, কণ্ঠের দরদে, শ্রুতিমধুর সংগীতায়োজনে এক কথায় সব মিলিয়ে এ এক অপূর্ব গান। অল্প সময়ে যেন মহাকালের মহাকাব্য রচিত হল। প্রেম, ইতিহাস, ব্যক্তিত্ব, স্বপ্ন, প্রাণে প্রাণে এক হবার আশার আকুতিতে, গানের দরদে, ছন্দে ফুটে উঠেছে করুণ মিনতির আবহ।

সংগীতের সাত সুর আর রঙ ধনুর সাত রঙ এক হয়ে মিশেছে প্রাণে, গানে, কল্পনার কল্পলোকের এক মহা সমারোহে যা শিল্পীর ধেরাজ কণ্ঠে বেজেছে শব্দকলা, সুর, ছন্দ, আবেগে। মন যেন ছুটে যেতে চায় রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা স্মৃতিময় তাজমহল স্থিত যমুনা কিনারে, আর এক তাজমহল বিনির্মাণের অসম্ভব প্রত্যাশায়, ভাবে, স্বপনের দেশে, হৃদে, প্রাণে।

ভাবতে অবাক লাগে এ সকল কল্পনা, ভাব শিল্পীর নয়, এ অপরূপ চিত্রকল্প সম্ভব করেছে এ গানের রচয়িতা, লেখক, গীতিকার, কবি মুদাসসীর আলীর লেখায়, রচনায়, ভাবপ্রবণতায়, কাব্যিক অনুরাগে। যা লিপিবদ্ধ আছে তাঁর রচিত ‘মধুমতির বাঁকে’ গ্রন্থে।

কালের গর্ভে বিলীন হতে হতে এ গান কিছু শিল্পী নামক প্রাণী নজরুল ইসলামের গান বলে অনায়াসে গেয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদ করার কেউ নেই। কারো কারো কাছে হয়তো এ গানের রচয়িতা, সুরকার, মূল গায়কের নাম জানা না থাকায় এবং সুর ও শব্দ প্রয়োগে নজরুলের গানের সাথে সাযুজ্য থাকায় বা কম প্রচলনের কারণে এমনটি হচ্ছে। অথচ অদ্যাবধি প্রথিতযশা কোন নজরুল সংগীতের শিল্পীর কণ্ঠে শুনিনি বা নজরুলের গান বলে কেউ রেকর্ডও করেন নি। এ গানের আরো বহুল প্রচার প্রসার হওয়া জরুরি।

অন্য গানটি বারো জন আউলিয়াদের নিয়ে। যাদের নামে চট্টগ্রাম পরিচিত ‘বারো আউলিয়ার স্থান’ নামে,

শোনেন যত দেশবাসী নর নারী গণ

বার আউলিয়ার কথা কিছু করিব বর্ণন

পাহাড় জংগল নদী ভরা জিলা চট্টগ্রাম

ময় মুরুব্বি আছেন যত জানাই সালাম।

সবার সেরা আছিল ভাইরে হযরত কেবলা

গাউছুল আযম মাওলানা শাহ আহাম্মদ উল্লাহ

শান শওকতে ভরা দরবার আছে মাইজভাণ্ডারে

প্রেমে কেনে খোদারে পায় শিখাইতেন সবারে।

তাঁর ভাতিজা মাওলা গোলাম রহমান

বূজুর্গীতে আছিল তিনি চাচার সমান

ইউছুপ নবীর মতন আছিল রূপে আর গুণে

তিরিশ বছর পালংগত্তুন ন নামিল জমিনে

ভাতিজা ও চাচার মাজার আছে মাইজভাণ্ডারে

মাইজভাণ্ডারি বলি ডাকে সকলে তারারে।

বোয়ালখালী গ্রামত আছিল কাজী আছদ আলী

কুতুবে জামান দরজা তার বূজূর্গ জালালী

মোগলশাহী দিঘী মসজিদ আছে তার মাজারে

পীর বলিয়া মাইনষে জীনে মাইনত তারারে।

নাসিরাবাদ সুলতান বায়জিদ বোস্তামীর মাজার

ছাড়ি আইলেন সিংহাসন তালাশে খোদার

পৈরের মাঝে আছে যারা আদত তারা জীন

বেয়াদবী গরনের ফলে হৈল রে কাছিম।

বিহারত্তুন আইলের বাবা শাহ আমানত

নানা জাতির ভক্তগণে গরে জিয়ারত

চরি গৈত্য জজর কোডত ঘুইরত্য পথে পথে

পরিচয় তার পাইল মাইনষে আজব কেরামতে

চাডিয়া শহরের মাঝে লালদিঘির পার

জেল রোডে তার মাজারে আলো বেশুমার।

নজির শাহের মাজার আছে ইস্টিশন রোডত

তেইরে কৈত শহর কুতুব এই শহরত

থাইকত রিয়াজউদ্দিন বাজার নিষিদ্ধ পাড়ায়

আস্তে আস্তে গোডা বাজার পাক হৈয়া যায়।

পীর বদর আলম নামে ব্‌ড় আউলিয়া

আইলেন তিনি জন্মভূমি মীরাট ছাড়িয়া

বদরপাতি মহল্লাটি বখশীর হাডর কাছে

তার নামের পরিচয় এই শহরেতে আছে

তার ডরে পালাই গেলগই যত জীন ও পরী

বদর বদর নামে মাঝি সাইগরে দে পাড়ি।

মাজার আছে আনোয়ারা বাবা মোহছেন আউলিয়া

পাথরত বই আইলেন তিনি সাইগর পাড়ি দিয়ারে

হেই মাজারত পৈত্য বছর ওরশ শরীফ হয়

খালি হাতে ফিরে না কেউ লোকমুখে কয় রে।।

মিছকিন শাহ আউলিয়ার মাজার এই শহরে

চট্টগ্রাম কলেজর কাছে টিলার উপরে

বড় এক শাহী জায়গীর আছিল তার নামে

কদলপুর আর আধারমানিক এই দুইয়ান গ্রামে।

শাহ জামাল শাহ কামাল তারা আউলিয়া দুইজন

মউ ভাগিনার দরগা বলি জানে সর্বজন

টাইগার পাশ চৌমূহনী দুই কবর তারার

পাশাপাশি দুই কবরে একখানত মাজার ।

পুলিশ লাইনর উত্তর পাশে বড় এক পাহাড়

মাজার আছে আউলিয়া গরীবউল্লাহ শাহর

যেইজন যিয়ান নিয়ত গরি হেই মাজারত যায়

দিলর মকছুদ আছান হয় তার আউলিয়ার দোয়ায়।

বার আউলিয়ার কিছু কথা আইজকার মতন শেষ

অন্য একদিন আশা রাখি গাইব বিশেষ

বার আউলিয়ার কুদরতি কৈয়ারে নাই শেষ

তারার দোয়ায় ধন্য হৈল সোনার বাংলাদেশ।

এত সহজ, প্রাঞ্জল ভাষায়, সাবলীল, সুচারুভাবে বারো আউলিয়ার পরিচয়, তাদের কীর্তি কাহিনির বয়ান কবি যেভাবে করেছেন তা কেবল বিরলই নয় অতুলনীয়। বারোজন আউলিয়ার পরিচয় এভাবে অন্য কোথাও পাই না। বার আউলিয়ার মাজার নামে সীতাকুণ্ডের কুমিরায় যার অবস্থান আসলে সেটি কোন বারোজন আউলিয়ার নামে তা আজ অবধি সঠিক নির্ণীত নয়।

কবি মুদাসসীর আলী সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় নি। জন্ম বরিশালের পিরোজপুরের অজ পাড়াগায়ে। চট্টগ্রাম বিওসিতে একাউন্ট্‌স অফিসে চাকরির সুবাদে সুদীর্ঘকাল চট্টগ্রামের চন্দনপুরায় সাগর সোপ ফ্যাক্টরির পুকুর পাড়ে ভাড়া বাসায় অবস্থান। এক ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, মেজ ছেলে মোহিতুল আজম (আমাদের বন্ধু) রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী বেতারে গাইত। মেয়ে বিলকিস বানু স্কুল শিক্ষিকা ও বেতার শিল্পী। তার রচিত একটি গ্রন্থ ছাড়া অন্য সৃষ্টি সম্পর্কেও বেশি কিছু জানা যায় না। তার সৃষ্টি সকল সংগ্রহ করে গাওয়া ও বহুল প্রচার সময়ের দাবি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী ও লোকসংগীত গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিতর্ক শুধু বক্তৃতা নয় এটি এক বুদ্ধিদীপ্ত ভাব বিনিময়
পরবর্তী নিবন্ধঅপ্রয়োজনীয় ব্যয় ভয়ংকরী, দরকার টেকসই পরিকল্পনা