কবিতা। সাহিত্যের মায়াবী সন্তান। ‘পৃথিবীর আলোয় ছন্দোবদ্ধ পদাবলীর যেদিন প্রথম জন্ম, সেদিন থেকেই এই মায়াবী সন্তানটির দিকে মানুষের কৌতূহল এবং কৌতুক, স্নেহ এবং সন্দেহ, বৈরাগ্য এবং ব্যাকুলতার মাত্রা প্রায় সমান সমান’। শব্দের বুননে কবি কবিতা নামক মায়ার জাল তৈরি করেন। সেই জালে আটকা পড়েন পাঠক। অতঃপর মুগ্ধতা ছাড়িয়ে মগ্ন হন তারা। কবিতার মায়ায় মগ্ন এসব পাঠক ভিড় করছেন নগরে চলমান বইমেলায়। এবারের বইমেলায় মায়ার (কবিতা) পসরা (কাব্যগ্রন্থ) সাজিয়েছেন অসংখ্য কবি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ ইতোমধ্যে পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ময়ুখ চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থ ‘অনিদ্রার কারুকাজ’ ও ‘পঞ্চবটী বনে’, কবি হোসাইন কবিরের ‘ডাহুক এখনো ডাকে’, রাশেদ রউফের ‘শ্রেষ্ঠ কিশোর কবিতা’, হাফিজ রশিদ খানের ‘নির্বাচিত কবিতা আদিবাসী পর্ব’, ওমর কায়সারের ‘দস্যু বনহুরের মতো’, আহমেদ মুনিরের ‘বাঘারুর সঙ্গে আলাপ’, রীতা ধরের ‘অন্ধ জোনাকি’, জিললুর রহমানের ‘পাগলার বন মরে পড়ে আছে’, স্বরূপ সুপান্থের ‘ভাষাবিহ্বল’, রিমঝিম আহমেদের ‘অনন্তকলহ’, লিপি বড়ুয়ার ‘মন জোনাকির ছায়াপথ’, নাহিদা খানম সিমুর ‘ভালোবাসায় মাতোয়ারা’, হেলাল চৌধুরীর ‘জলমোতির অশ্রুজল’, মাহবুবা চৌধুরীর ‘হাতের দু’ভাজে ঘুম’, হেলাল চৌধুরীর ‘জলমোতির অশ্রুজল’, আফছার উদ্দিন লিটনের ‘অধরা প্রেম’, ইমরুল কায়েসের ‘ভুবনমোহিনী’ এ জে মামুনের ‘অনন্ত প্রেমের কাব্য’।
কবিতার বই প্রসঙ্গে কবি কামরুল হাসান বাদল দৈনিক আজাদীকে বলেন, সবসময় কবিতার বই বেশি প্রকাশিত হয়। বলা হয়ে থাকে, এমন কোনো বাঙালি পাওয়া যাবে না যে জীবনে একবার না একবার কবিতা লেখার চেষ্টা করেনি। কবিতার প্রতি বাঙালিদের আলাদা একটা মোহ আছে, কবি হয়ে উঠবার বা কবিতা লিখবার। ফলে কবিতার বই সবসময় বেশি হয়। এবারও বেশ সংখ্যক কবিতার বই বেরিয়েছে। প্রবীণদের পাশাপাশি তরুণ কবিদের মধ্যেও অনেকে বই বের করেছেন। আশাব্যঞ্জক হচ্ছে, কবিতার বই চলছেও। বিক্রি হচ্ছে। এদিকে বইমেলা ঘুরে দেখা গেছে, পাঠকের নজর কেড়েছে ১৯৭০ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত বিস্তৃত সময়-পরিসরে রচিত ৪৮টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত ময়ুখ চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থ ‘অনিদ্রার কারুকাজ’। দীর্ঘ সময়ের যাত্রা, তাই কাব্যগ্রন্থটির কবিতায় বিষয়-বৈচিত্র্য সহজেই চোখে পড়ে। প্রকাশভঙ্গিমারও ভিন্নতা রয়েছে। তবে কবিতাগুলো কালানুক্রমিকভাবে সাজানো হয়নি। কারণ, ‘ময়ুখ চৌধুরী থিমেটিক চেইন ও কবিতার মেজাজ অনুযায়ী কবিতা বিন্যাস করতে পছন্দ করেন’।
অন্যের কষ্টে দগ্ধ হন কবিরা। ছটপট করেন বেদনায়। ব্যতিক্রম নন কবি ময়ুখ চৌধুরীও। তাকেও আহত করে মানুষের দুঃখ ও যন্ত্রণা। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘অনিদ্রার কারুকাজ’ভুক্ত ‘জনৈক বেকারের উক্তি’ কাব্যে। ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর রাতের বেলায় মর্মান্তিক ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু সংবাদে ভরপুর সংবাদপত্র দেখে একই বছরে ১৬ নভেম্বর লিখেছেন কবিতাটি। কবির ভাষায়, ‘সময়টা পাতা গুনে, তারা গুনে কাটিয়েছিলাম বহুদিন।/ সেইভাবে আজও, শুরু থেকে শেষ পৃষ্ঠা দেখলাম, দেখলাম, দেখলাম-/ অগণিত মৃতদেহ পড়ে আছে এদিকে সেদিকে, সবখানে;/ দ্রষ্টব্য সবখানে মৃতের করুণ ছবি গণনার অতীত’।
৪১টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কবি হোসাইন কবিরের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘ডাহুক এখনো ডাকে’। এ যেন প্রাকৃতজন, নিবিড় অরণ্য ও পাখির অবাধ উড়াউড়ি আর নদীমাতৃক ভূগোলের প্রতিরূপ। করোনাক্রান্তিতে রচিত কবিতাগুলো। তাই কাব্যের ছন্দে ফুটে উঠেছে সময়ের মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা, মানুষের অর্ন্তগত বেদনার সুর, নিঃসঙ্গে নিঃশ্বাস নেবার আকুতি আর একাকী প্রস্থানে অভিমানের উচ্চারণ। কবির ভাষায়, ‘যেতে যেতে পথে শুনতে চাই না আর/ শাদা চুম্বনের শোকার্ত অ্যাম্বুলেন্সের/ দুঃসহ বেদনার- মাতাল ঝুমঝুমি /কিংবা/ যেতে হয় যাবো নির্জনে একাকী’।
গত চার দশক ধরে কবিতা লিখছেন ওমর কায়সার। এবার বইমেলায় বেরিয়েছে তার কাব্যগ্রন্থ ‘দস্যু বনহুরের মতো’। যেখানে পাঠককে এক স্বপ্নমোহাচ্ছন্ন ভূমিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কবি। বিস্ময় ও বিস্মরণের পথ ধরে এ এক আশ্চর্য ভ্রমণ। ফ্ল্যাপে লেখা আছে, অলৌকিক জ্যোৎস্নার ভেতর থেকে ছেলেবেলার দস্যু বনহুর মাঝে মাঝে সামনে এসে দাঁড়ায়। তার পরনে কবিতার পোশাক। কোনো এক বাঘিনীর ক্ষুধার ভেতর যে ভাষার জন্ম সে ভাষায় কথা বলে সে। হেমন্তে ঝরা জলপাইয়ের পাতার কম্পন তোলে তার শব্দরাশি। চার দশক ধরে নিজস্ব কাব্যভাষার এক মণি খচিত ইমারত গড়ে তুলেছেন ওমর কায়সার। ‘দস্যু বনহুরের মতো’ কাব্যগ্রন্থ সেই ইমারতের গায়ে নতুন হীরকখণ্ডের মতো দ্যুতি ছড়াবে, তাতে সন্দেহ কি।
২০০৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা ও সাময়িকীতে ছাপা হওয়া ‘বাঘা’ সিরিজের কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কবি আহমেদ মুনিরের কাব্যগ্রন্থ ‘বাঘারুর সঙ্গে আলাপ’। কবির এক যুগেরও বেশি সময়ের চিহ্ন লেগে আছে এইসব কবিতার পঙক্তিতে। ফ্ল্যাপের তথ্য অনুযায়ী, আহমেদ মুনিরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমি ও বাঘারু’ প্রকাশের পর বাঘারু সিরিজের আরও কিছু কবিতা লেখা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। প্রথম বইয়ে এই সিরিজের সঙ্গে অন্য কবিতাও ছিল। তবে এবার এক সঙ্গে বাঘারু সিরিজের সব কবিতা পাঠকের জন্য নিবেদন করা হলো ‘বাঘারুর সঙ্গে আলাপ’ এ। সেদিক থেকে কাব্যগ্রন্থটি স্বতন্ত্র একটি প্রয়াস।
পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে কবি রীতা ধরের কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধ জোনাকি’। যেখানে শব্দের নিপুণতা আর নৈসর্গিক প্রেমের ভাবধারায় কবি চেষ্টা করেছেন সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার আকুতিকে তুলে এনে তাকে অনন্তের পিরামিডে গেঁথে রাখতে।
প্রসঙ্গত, নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে চলছে বইমেলা। গতকাল ছিল মেলার অষ্টম দিন। মেলার আয়োজক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। তবে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য শিল্প-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরাই সম্মিলিতভাবে এ মেলা বাস্তবায়ন করছেন। মেলা চলবে ১০ মার্চ পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকেল ৩ টা থেকে রাত ৯ টা ও ছুটির দিন সকাল ১০ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত সর্ব সাধারণের জন্য মেলা উন্মুক্ত থাকবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিবেদন করা হয়েছে এবারের মেলা। মেলায় ৯৫ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ১২০টি স্টল আছে।
আলোচনা সভা : গতকাল বইমেলার মঞ্চে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম.এ সালাম। দৈনিক সুপ্রভাতের সম্পাদক রুশো মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার। বক্তব্য রাখেন মেলা কমিটির আহ্বায়ক ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু ও ন্যাপ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মিঠুল দাশগুপ্ত।
এম এ সালম বলেন, বিশ্বায়নের এ যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব দরজা মানুষের জন্য খোলা। সময়ের সাথে এগিয়ে যেতে হলে নতুন প্রজন্মকে অত্যন্ত যুক্তিবাদী, দেশপ্রেমিক, পরমতসহিষ্ণু হিসেবে গড়ে তুলতে হবে আগামীদিনের জন্য।