বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যার্থে নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ারে আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশে তবলা পরিবেশন করেছিলেন তাঁর ওস্তাদ আল্লা রাখা খাঁ। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ। বিশ্বখ্যাত তবলাবাদক ওস্তাদ আল্লারাখা খাঁ ১৯১৯ সালের ২৯ এপ্রিল ভারতের পাঞ্জাব জেলার রতনগড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আল্লারাখা কুরেশি খান সাহেব। নেশা ও পেশায় তিনি ছিলেন তবলাবাদক। বিশ্বজুড়ে তবলা বাজানোর মাধ্যমে এ শিল্পকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলেন এবং যন্ত্রটির মর্যাদা ও সম্মান উচ্চতর শিখরে নিয়ে যান তিনি। সবার কাছে আব্বাজি বলেই পরিচিত ছিলেন তিনি। ওস্তাদ জাকির হোসেন, ফজল কুরেশি ও তওফিক কুরেশি ছিলেন তারই সন্তান এবং সবাই ছিলেন বিখ্যাত তবলাবাদক। ওস্তাদ আল্লারাখা খাঁর বাবা ছিলেন একজন কৃষক। তার বাবা ভেবেছিলেন তার ছেলেও তার মতো কৃষিকাজে মনোনিবেশ করবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। কৃষিকাজে আল্লারাখার কোনো আগ্রহ ছিল না। তার আগ্রহ ছিল সংগীতে। তাঁর অন্যতম সুযোগ্য পুত্র কিংবদন্তি তবলাবাদক ওস্তাদ জাকির হোসেন আর নেই। জাকির হোসেন পড়াশোনা করেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। এরপর ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। শুরু হয় তাঁর আন্তর্জাতিক সংগীতাঙ্গনে বিচরণ। ১৯৭৩ সালে জর্জ হ্যারিসনের লিভিং ইন দ্য ম্যাটেরিয়াল ওয়ার্ল্ড অ্যালবামে অংশগ্রহণ তাঁকে এনে দেয় এক বিরাট স্বীকৃতি। তার পর থেকেই বহু খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী যেমন জন ম্যাকলাফলিন, মিকি হার্ট, বিল ল্যাসওয়েল, ভ্যান মরিসন, জো হেন্ডারসনসহ আরও অনেকের সঙ্গে তবলা পরিবেশন করেন তিনি।
সংগীতে তাঁর কর্মজীবনের সিংহভাগজুড়ে রয়েছে ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীত। তবলায় তিনি সংগত করেছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, শিব কুমার শর্মা বা কত্থক নৃত্যশিল্পী বিরজু মহারাজকে। ১৯৯২ সালে জাকির হোসেন প্রতিষ্ঠা করেন ‘মোমেন্ট রেকর্ড’। এর মাধ্যমে তিনি সংগীতানুরাগীদের উপহার দিয়েছেন ভারতের ধ্রুপদি সংগীতের খ্যাতিমান সেরা সংগীতশিল্পীসহ সমকালীন বিশ্বসংগীত। ২০০৬ সালে ‘মোমেন্ট রেকর্ড’–এর মুক্তিপ্রাপ্ত অ্যালবাম ‘গোল্ডেন স্ট্রিং অব দ্য সরোদ’ গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, গ্র্যামি ছাড়াও আরও বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জাকির হোসেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’–এর অন্যতম সদস্য ছিলেন ওস্তাদ জাকির হোসেনের বাবা আল্লারাখা খাঁ।
আগস্ট ০১,১৯৭১।
নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজন করা হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে, কিন্তু জীবন বাঁচাতে এরই মধ্যে লাখ লাখ মানুষকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে তখন খাবারের সংকট, আর কলেরা রোগে মানুষের জীবনকে আরো সঙ্গিন করে তুলেছে। পরিস্থিতির মুখোমুখি। এমন এক অবস্থায় রক সংগীত জগতের অগ্রণী ব্যান্ড বিটলস–এর জর্জ হ্যারিসন ও বিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর আয়োজন করেন এই কনসার্টের। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে কনসার্টের আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেন সেই সময়কার বিখ্যাত শিল্পীরা, তাদের মধ্যে রয়েছেন – পণ্ডিত রবিশঙ্কর (সেতার), ওস্তাদ আলি আকবর খান (সরোদ), আল্লা রাখা খাঁ (তবলা), কমলা চক্রবর্তী (তানপুরা), জর্জ হ্যারিসন (কন্ঠ, গিটার), রিঙ্গো স্টার (কন্ঠ, ড্রামস, তাম্বুরা), লিওন রাসেল (কন্ঠ, পিয়ানো, বেস গিটার), বিলি প্রিস্টন (কন্ঠ, অর্গান), এরিক ক্ল্যাপটন (লিড গিটার), বব ডিলান (কন্ঠ, গিটার, হারমোনিকা), ক্লস ভোরম্যান (বেস গিটার), জিম কেল্টনার (ড্রামস), ব্যাড ফিঙ্গার (রিদম গিটারস, নেপথ্য কন্ঠ), পিটি হাম, টম ইভান্স, জোয়ি মোলান্ড এবং মাইক গিবসন, জেসি এড ডেভিস (লিড গিটার), ডন প্রিস্টন (লিড গিটার, কন্ঠ), কার্ল র্যডলি (বেস গিটার), দ্য হলিউড হর্নস্, জিম হর্ন, এলান বিউটলার, চাক ফিন্ডলে, জ্যাকি কেলসো, লু ম্যাকক্রেরি, ওলি মিচেল, ডন নিক্স, জো গ্রিন, জেনি গ্রিন, মার্লিন গ্রিন, ডলরেস হল, ক্লডিয়া লিনিয়ার প্রমুখ।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজন করার মূল রূপকার ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তখন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিতই পত্রপত্রিকায় খবর পাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীর ঢল নেমেছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে তিল ধারণেরও ঠাঁই নেই। বাংলাদেশে গণহত্যা, নিপীড়ন, ধর্ষণ–এসব নিয়ে বিশ্ববিবেকের মতো নিজের কাছে নিজেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। এদিকে ভারতের খবর শুনছেন, শরণার্থীদের সহায়তা দেওয়া ঠিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না। পণ্ডিত রবিশঙ্কর ভাবলেন, যদি একটি কনসার্ট করা যায়! সেই কনসার্ট থেকে উপার্জিত অর্থ পাঠানো যাবে ওই শরণার্থীদের সাহায্যে। তাঁর মাথায় এলো জর্জ হ্যারিসনের কথা।
১৯৭১ সালে জর্জ হ্যারিসনের সংগীতগুরু পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁকে বাংলাদেশে চলমান মানবিক সংকটের বিষয়ে জানান। হ্যারিসন তাৎক্ষণিকভাবে শরণার্থীদের সাহায্য করতে কনসার্টের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের চিন্তা করেন। নিজের খ্যাতি আর বিখ্যাত সব বন্ধুর সাহায্য নিয়ে তিনি শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ান। ছিলেন ভারতীয় সরোদবাদক আলি আকবর খান ও তবলাবাদক আল্লা রাখার মতো ভারতীয় সংগীতের সুপরিচিত ওস্তাদরাও।
জুলাইয়ের শুরুতেই একটি ছোট বিজ্ঞাপন ছাপা হয় নিউইয়র্ক টাইমসের পেছনের পাতায়– ‘হ্যারিসন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ দুটো কনসার্ট আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য। বিটলসদের সম্ভাব্য রি–ইউনিয়নের আঁচ পেয়েই হোক, তারকাদের নাম দেখেই হোক কিংবা বহুদিন পর কনসার্ট হচ্ছে এই খুশিতেই হোক– মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যে দুটো কনসার্টের ৪০ হাজার টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে যায়। আয়োজনের কথা জেনে সাংবাদিকরা ১২ হাজার ডলার অনুদান দিলেন আয়োজকদের।
সংবাদ সম্মেলনে হ্যারিসনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, দুনিয়াতে এত সমস্যা থাকতে হঠাৎ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তাঁর কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে কেন? তাঁর সোজাসাপ্টা উত্তর ছিল গানের কথাগুলোর মতোই– আমার বন্ধু আমার কাছে সাহায্য চেয়েছে, আমার মনে হয়েছে, আমার তাঁর পাশে দাঁড়ানো উচিত। যদিও সংবাদ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা এসেছে, কিন্তু কনসার্টের আয়োজনের কারণ হিসেবে সেই বিষয়টা সচেতনভাবেই এড়াতে চেয়েছেন হ্যারিসন। যাতে কোনো রাজনৈতিক রং না লাগে এবং তৎকালীন নিক্সনের প্রশাসন এ নিয়ে বিরাগভাজন না হয়। সেজন্য বাংলাদেশের দুর্গত শিশুদের ত্রাণের কথা বলেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, কনসার্ট থেকে পাওয়া সব অর্থ ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থী শিশুদের সাহায্যে পাঠানো হবে। এমনকি কনসার্টের পোস্টারেও ব্যবহৃত হয়েছে একটি শিশুর ছবি, রেকর্ড লেবেলেও।
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ভারতীয় শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। পরিবেশিত হয় বাংলা লোকসংগীতের অনন্য সুর ‘বাংলা ধুন’। আর কনসার্টের শেষ গানটি ছিল জর্জ হ্যারিসনের লেখা ‘বাংলাদেশ’। যে ‘বাংলাদেশ’ নামটি পশ্চিমা বিশ্বে কেউ চিনত না বলা যায়, এই কনসার্টের কারণে এক দিনের মধ্যেই তা পরিচিত হয়ে ওঠে। এই কনসার্ট হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক সাহসী প্রতিবাদ। বাংলাদেশ নিয়ে কনসার্ট আয়োজনের পর সাক্ষাৎকারে হ্যারিসন বলেছিলেন, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ছিল একটি নৈতিক পদক্ষেপ… আমরা দেখিয়েছি, রাজনীতিকদের চেয়ে শিল্পী ও সাধারণ মানুষ বেশি মানবিক। মানুষ রকশিল্পীদের চ্যারিটির জন্য পারফর্ম করাকে গ্রহণ করেছে।’ জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ গানটি ছিল কনসার্টেও অন্যতম আকর্ষণ। ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ/ হে প্রভু, বীভৎস দৃশ্য এমন দেখিনি কভু/ অকাতরে ঝরে হেথায় সহস্র প্রাণ/ এগিয়ে এসো হে মানুষ মহান/ তুমি কি বুঝবে না/ মুখ ফিরিয়ে থেকো না/ মুক্ত কর হে বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এসব বিদেশি শিল্পীরা অন্যরকম ভূমিকা রাখেন। আসলে শিল্পীর কোনো সীমারেখা নেই, নেই সীমানা। শুধু বিবেক বোধের তাড়নায় বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিদেশি বন্ধু বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে তাদের অবদানও অনস্বীকার্য।