সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নে বিএম কনটেনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে হতাহত হওয়ার ঘটনায় আমরা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। অগ্নিকাণ্ড ও কন্টেনার বিস্ফোরণের ঘটনায় এতোজন হতাহত হওয়ার বিষয়টি রীতিমত উদ্বেগজনক। এ যাবৎ অন্য কোনো বিস্ফোরণে এতো লোক মারা যায় নি। এ ঘটনায় আমরা মর্মাহত।
স্মার্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বিএম কনটেনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়া আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়েছে। বিস্ফোরণে কনটেনার থেকে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ সময় লাগলো বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে। এদিকে অন্য এক গণমাধ্যম বিস্ফোরক পরিদফতরের বরাত দিয়ে বলছে, হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের মতো অধিক দাহ্য কেমিক্যাল মজুত করার অনুমতি নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বিস্ফোরক অধিদফতরের তালিকায় ওই প্রতিষ্ঠানের নামও নেই। তবে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের সবধরনের কাগজপত্র রয়েছে। এমনকি কাস্টমসের ছাড়পত্রেও তা উল্লেখ আছে। তবে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বিএম কনটেনার ডিপোসহ অন্য সব ডিপোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রয়েছে ত্রুটি। দাহ্য পদার্থ আমদানিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের কড়াকড়ি নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি।
সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি এলাকার বিএম কনটেনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষতিগ্রস্তদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় দলীয় নেতাকর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। রোববার প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক শোকবার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রী আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ারও নির্দেশনা দেন। দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে সরকারের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
বিএম ডিপোর ঘটনা তদন্তে টার্মিনাল ম্যানেজারকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে ৩ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেনার ডিপো পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। পরিদর্শনকালে ডিপোতে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণসহ সর্বশেষ পরিস্থিতি সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন। তিনি ডিপোতে এখনো অক্ষত থাকা হাইড্রোজেন পারক্সাইডসহ রাসায়নিক পণ্যভর্তি কয়েকটি কনটেনার সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দেন। মালিকপক্ষ ও কনটেনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাঁর মতে, অক্ষত কনটেনারে আগুন ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ডিপোতে হাইড্রোজেন পারক্সাইডবাহী ২৬টি কনটেনার ছিল। ডিপোর টিনশেডেও প্লাস্টিকের জারে এই রাসায়নিক ছিল। আগুন লাগার পর কনটেনারে থাকা রাসায়নিকভর্তি জার ফেটে যায়। এতে হাইড্রোজেন পারঙাইড বের হয়ে কনটেনারের সংস্পর্শে আসে। অঙিজেন নির্গত হয়ে পানি ও আগুনের সংস্পর্শে কনটেনারের ভেতরে তাপমাত্রা বেড়ে বিস্ফোরণ ঘটে। কনটেনার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে স্প্রিন্টারের মতো তা ছড়িয়ে পড়ে। হাইড্রোজেন পারক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। তিনি বলেন, এই ডিপোতে ‘আইএসপিএস কোড’ কমপ্লায়েন্স বা নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। আইএসপিএস কোড হলো আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা প্রণীত বন্দর ও বন্দর-সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাসংক্রান্ত ব্যবস্থা। বিপজ্জনক পণ্য রাখার জন্য ডিপোতে আলাদা ইয়ার্ডও দেখেছেন তিনি।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দ্রুত দুর্ঘটনাকবলিত কনটেনার ক্রেন দিয়ে সরিয়ে আলাদা জায়গায় রাখি। রাসায়নিক হলে পানির পরিবর্তে ফোম ব্যবহার করি। এখানে হাইড্রোজেন পারক্সাইডের মতো বিপজ্জনক পণ্যে আগুন লাগার পর ক্রেন দিয়ে কনটেনার সরিয়ে নিলে দুর্ঘটনার ভয়াবহতা কমে যেত।’এই দুর্ঘটনার জন্য মালিক কর্তৃপক্ষ ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। যদিও ক্ষতিপূরণ দিলেও পরিবারের নিহত লোকটি আর ফিরে আসবে না, তবু মানবিক কারণে তাঁরা ঘোষণা দিয়েছেন। কেউ এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রত্যাশা করে না। কিন্তু এতো বড় দুর্ঘটনার পেছনে কোনো ধ্বংসাত্মক তৎপরতা সংঘটিত হলে, তা হবে দুঃখজনক। বিএম কনটেনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় শুধু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন- তা নয়, পুরো অর্থনীতির চাকাও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা এ পরিস্থিতির দ্রুত উত্তরণ চাই।