কথায় ও স্মৃতিচারণে খালিদ আহসানকে স্মরণ

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ১৭ মার্চ, ২০২৫ at ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

এতোদিন রেখেছেন বাতাস খাইয়ে

এখন ফলের রস

ক’দিন পর বলবেন স্বর্গীয় হও চিরতরে”

নারীর আর্তি ১কবিতায় ঠিক এমনটাই লিখেছেন কবি খালিদ আহসান এবং এখন তাই হয়েছে, চিরতরে স্বর্গীয়। তাই এখন আমাদের স্মরণ করতে হচ্ছে কথায় ও নানান বর্ণিল স্মৃতিচারণে।

২২ মার্চ ২০২১। চিরবিদায় নিলেন খালিদ ভাই। মানুষ অমর নয়। যেতে তো হয়। কিন্তু কারো কারো আকস্মিক যাওয়ামেনে নেওয়া কঠিন। খালিদ ভাই ছিলেন তেমনই এক মানুষ। সাহিত্য পত্রিকা “আন্দরকিল্লা” প্রকাশ করেছে “খালিদ আহসান সংকলন”যেখানে বর্ণিত হয়েছে খালিদ আহসান সম্পর্কে অনেক জানাঅজানার তথ্য। যেহেতু খালিদ ভাই ছিলেন কবি, প্রচ্ছদ শিল্পী, গীতিকবি, আড্ডাবাজ দারুণ তারুণ্যে ভরপুরসুতরাং, খালিদ ভাইকে নিয়ে এই সংকলন বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। যারা খালিদ ভাইকে যে যার অবস্থান থেকে এবং যেভাবে কাছে থেকে দেখেছেন, অনুভব করেছেন, লেখাগুলো সেই ভাবেই রচিত। আর তাই খালিদ ভাই ফিরে আসে বারবার স্মৃতিতেঠিক তিনি যেভাবে লিখেছেন:

আমি পুষ্পের আদলে আবার

পৃথিবীর মানচিত্রে

আবার পৃথিবীর কোন সহজ সমীকরণের

সূত্রে ফিরে আসবো

প্রত্যাবর্তনের গল্প শোনাবো বলে।”

(ফিরে এসে গল্প হবে। পৃথিবীর শিরাউপশিরা)

মিনার মনসুর লিখেছেন: “তিনি আমার অস্থির অনিশ্চিত শিল্পযাত্রার সূচনালগ্নের সঙ্গী, সহযাত্রী ও সারথি। মহাবীর অর্জুনের সারথি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আমার জীবনের ঊষালগ্নে খালিদ আহসানের ভূমিকাও ছিল তাই। তিনি ছিলেন একাধারে আমার বন্ধু, বড়ভাই ও উপদেষ্টা।”

আহমাদ মাযহার লিখেছেন: “বইয়ের প্রচ্ছদকর্ম বা বইনকশায় তাঁর স্বতন্ত্র শিল্পরুচি সবসময়ই আমাকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে রেখেছে।”

অভীক ওসমানের দৃষ্টিতে আমরা আরেক খালিদ আহসানকে আবিষ্কার করি। অভীক ওসমান লিখেছেন: “তিনি সত্যিকার মেধা খুঁজে খুঁজে বেড়াতেন। তাদের সাথে আড্ডা দিতেন। তাদের জন্য খরচ করতেন। এমন কি নিজ খরচে চট্টগ্রামের অনেকের বই প্রকাশ করে দিয়েছেন। বোহেমিয়ান ও ভাঙাগড়ার কবি সুনীল নাথের প্রতি তার ছিল প্রগাঢ় দুর্বলতা। তাঁর মৃত্যুর পর চেরাগি মোড়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে শ্মশান পর্যন্ত খালিদ আহসান অভিভাবকত্ব দিয়েছেন। এই ধরনের মঙ্গলময় কাজ তিনি করেছেন।”

চট্টগ্রামে নিউমার্কেট মোড়ে চিম্বুক রেস্তোরাঁ ছিল একসময়ের জমজমাট মিলনমেলা। কবি শিশির দত্ত স্মৃতিচারণে লিখেছেন: “প্রকৃতি ও মানুষ এই দুইয়ের ভিতরেই খালিদ আজীবন বিচরণ করেছে। রুচিবোধ, রোমান্টিকতা, জীবনযাপনের সুধারসকে আকণ্ঠ পান করেছে। তাঁর অনুজ, সমসাময়িক ও অগ্রজ কবিদের সাথে সখ্যতা ছিল অনেক গভীর। সাধুর দোকানের আড্ডায় খালিদের আসাযাওয়া ছিল নিয়মিত। ‘চিম্বুক’ রেস্তোরাঁর আড্ডায় বলা চলে প্রতিদিনই খালিদের উপস্থিতি আমাদের অনেক ভাবনা চিন্তাকে উৎসাহিত করেছিল। ‘শুধু চোখ তুলে দেখি তাঁর যাওয়া’ এমন পথ চলায় খালিদ ছিল আপাদমস্তক প্রেমিক পুরুষ। ভালোবাসার প্রতি তাঁর কাঙালপনা থাকলেও তাঁর প্রিয় মানুষগুলোকে খুব দ্রুত সম্মানের জায়গায় নিতে পারার ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। নিজেকে চিনতে চেয়েছে সে বারবার। আবিষ্কার করতে চেয়েছে নিজের ভাল লাগার নির্বাচিত পঙক্তিগুলোকে, যেখানে খালিদ একেবারেই স্বতন্ত্র।”

গল্পকার হিসেবে অন্য এক খালিদ আহসানকে আবিষ্কার করেছেন কবি স্বপন দত্ত। তিনি লিখেছেন: “খালিদের বাউল মনের তৎকালীন ছবিটাকেই ধরা যাক। কথাটা হচ্ছিল স্পার্ক জেনারেশনে খালিদ আহসানের গল্প লেখা নিয়ে। বলেছিলাম, গল্পের বিষয়টার ধরণ তেমনই করতে হবে, তাতে যেনো তোমার এই সময়ের জীবনভাবনার ঘ্রাণ পাওয়া যায়। বুঝি বা তাই, কবি খালিদ আহসানকে গল্পকার খালিদ আহসান হিসেবে পাওয়া হলো অন্য এক রূপে। সে তার আদি ও একমাত্র যে গল্পটি স্পার্ক জেনারেশনের জন্য লেখে, তার নাম রেখেছিলো “নমিতা, বসতবাড়ি উপড়ে ফেলো।” গল্পটির আস্বাদ মৃত্যুর অজানা স্বাদের অতৃপ্তির মতো।”

মহীবুল আজিজ লিখেছেন: “কবিচিত্রী, সংস্কৃতিকর্মী, ডিজাইনার, সংগঠক যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই তাঁকে চিহ্নিত করা চলে। আবার খালিদ ভাই বললেও চলে। আমাদের অনেকের কাছে তাঁর সবগুলো পরিচয় সম্মিলিত হয়ে মাত্র তিনটে বর্ণের দু’টো শব্দে এসে দাঁড়ায়। এই দুই শব্দের ডাক থেকেই বলা চলে, তিনি আমাদের অন্তরের সেই মানুষটা, আমাদের মনের সেই জায়গাটাতে তাঁর অবস্থান যেখানে রয়েছে দীর্ঘকালের প্রবহমানতা, দীর্ঘ চলার অভিজ্ঞতা।….. খালিদ আহসান মানে উন্মত্ত আশি জুড়ে চলমান সংক্ষুব্ধতার মাঝখানে স্থিতধী নান্দনিক এক নির্ভরতা, খালিদ আহসান মানে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকাল থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত কোনো না কোনো ইতিবাচক কাজের উৎসভূমি।”

কবি খালিদ আহসানের সাথে আজও আড্ডায় মেতে ওঠার আশা নিয়ে আরেক কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী লিখেছেন: “যাঁরা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন তারা জানেন, খালিদ আহসানের সঙ্গে একান্ত আলাপের মুহূর্তগুলো কী উপভোগ্য। প্রায়ই সেই আলোচনা ছিল পার্থিব জগৎসংসারের বাইরের বিষয় নিয়ে। হাসপাতালে ভর্তির ঠিক আগের দিন আপনার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিলো খালিদ ভাই। করোনাকাল শেষ হলে একদিন কোথাও বসব, অনেক কথা হবে, ঠিক হয়েছিল। সেই আড্ডার তৃষ্ণাটা রয়ে গেল।”

জ্যোতির্ময় নন্দী বড্ডো আক্ষেপ করে লিখেছেন: “খালিদকে হারিয়ে আমার বন্ধুজগৎ, চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য জগৎ অনেকটাই গরিব হয়ে পড়েছে, খুব ভারাক্রান্ত মনে এ কথা ভাবি।”

হাফিজ রশিদ খান লিখেছেন: “শিল্পক্ষুধার আগুনে পোড়া খালিদ আহসান আমাদের কাছে জেগে থাকবেন শিল্প সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল শতভিষা হয়ে। তিনি যেন আমাদের আদুর গায়ে একটি স্নিগ্ধ, উষ্ণতামাখা শীতের দোআড়ি।”

সুরকার ও গায়ক নকীব খান খালিদ ভাইয়ের লেখা পাঁচটি গান সুর করেছেন। গীতিকবি খালিদ আহসান সম্পর্কে নকীব খান লিখেছেন: খালিদ আহসান ভাই মূলত একজন কবি ও অসাধারণ প্রচ্ছদ শিল্পী। তাঁর শৈল্পিকতা ও মননশীলতা সবাইকে মুগ্ধ করেছে। আর তিনি এভাবেই সকলের কাছে পরিচিত। অথচ খুব অল্প সংখ্যক গান লিখে, তাঁর লেখনীর গভীরতা ও মননশীলতার মাধ্যমে তবে তিনি জনপ্রিয় গীতিকবি হিসেবে সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি এক নিভৃতচারী, মাটির কাছাকাছি মানুষ, যিনি আমাদের সবার কাছে একজন আধুনিক গীতিকবিতায় আধুনিকতার প্রতীক হয়ে থাকবেন।”

একচল্লিশ জন লেখকের লেখায় সমৃদ্ধ এই খালিদ আহসান সংকলন।

সাহিত্য পত্রিকা “আন্দরকিল্লা” সম্পাদক নুরুল আবসার তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করে লিখেছেন: খালিদ আহসান অনেকের মতন আমারও একজন কাছের মানুষ, মনের মানুষ। তাকে স্পর্শ করতে মনপ্রাণ সবসময় আনচান করে। এই তাড়না থেকেই সমকালের চেয়েও অধিকতর অগ্রবর্তী ধ্যানী খালিদ আহসানকে ধরে রাখতে অনেককে নিয়ে অনেক দিনরাত্রির অনুসন্ধানের নির্যাসের রস মলাটবন্দী আন্দরকিল্লা’র এই সংকলন।

খালিদ আহসান সংকলনএর অতিথি সম্পাদক কবি শোয়েব নাঈম। তিনি লিখেছেন: অতৃপ্তির কোনো বিরোধ দিয়ে নয়, বরং প্রাপ্তি স্বীকারের কৃতজ্ঞতা দিয়ে বলছি, সূচিপত্র হয়ে থাকা এসব লেখাগুলিই এই সংকলনে হয়ে উঠেছে ‘খালিদ আহসান’ নামক এক ধ্রুপদী জীবনের পুনরুজ্জীবন। যেখানে খালিদ আহসানের বিস্তার আর বিপুলতা এসব লেখনির মাধ্যমে আরও স্পষ্ট এবং লেখনির প্রাসঙ্গিকতায় অনাবিষ্কৃত খালিদ আহসান আরও বেশি আলোকিত।”

২২ মার্চ ২০২১ সালে খালিদ আহসান আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন চিরতরে। তাঁর সৃষ্টিকর্মই আমাদের মাঝে খালিদ ভাইকে জাগিয়ে রেখেছেকবিতায়, গানে, প্রচ্ছদচিত্রে।

খালিদ আহসান সংকলন

সম্পাদক: নুরুল আবসার

অতিথি সম্পাদক: শোয়েব নাঈম

প্রকাশক: ‘আন্দরকিল্লা’ সাহিত্য পত্রিকা, মোমিন রোড, চট্টগ্রাম

প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২৫

প্রচ্ছদ : খালিদ আহসানএর চিত্রকর্ম এবং আইভি হাসানএর পরিকল্পনা।

সংগ্রহ মূল্য : তিনশত টাকা

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের বিধানদা