কত উজির নাজিরের জীবন গেল, আড্ডা কিন্তু থামেনি

বিশ্বজিৎ চৌধুরী | শুক্রবার , ৪ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

পর্ব-৩

অচিরা পাঠচক্রের কিছু আগে থেকেই আরেকটি আড্ডা ছিল জমজমাট। এনায়েত বাজার মহিলা কলেজের পাশে একটি বাড়ির নিচতলার অপরিসর কামরায় তখন থাকতেন কবি-সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত। এই অকৃতদার সজ্জন ব্যক্তিটির ঘরে তখন ভিড় করতেন নবীন-প্রবীণ অনেক কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী। অনুপম সেনের মতো প্রাজ্ঞ সমাজবিজ্ঞানী ও লেখক যেমন যেতেন সেখানে, তেমনি খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, দৈনিক আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, অধ্যাপক-গবেষক রশীদ আল ফারুকী, ‘চট্টলতত্ত্ববিদ’ নামে খ্যাত আবদুল হক চৌধুরীও হাজির হতেন আড্ডার লোভে। তখন অপেক্ষাকৃত তরুণ কবি-লেখকদের মধ্যে স্বপন দত্ত, আহমেদ খালেদ কায়সার, অরুণ সেন, হরিশংকর জলদাস, আশীষ সেন, অজয় দাশগুপ্ত, সাথী দাশ, রবীন ঘোষ প্রমুখও হাজিরা দিতেন প্রায় নিয়মিত। অনুমান করি, সমাজ-রাজনীতি থেকে গান-কবিতা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই আড্ডার বিষয়ের পরিধি। এর বেশ কিছুকাল পরে অরুণ দাশগুপ্ত তাঁর এনায়েত বাজার এলাকার বাসস্থান ছেড়ে রহমতগঞ্জের ‘যোগেশ ভবনে’ থাকতে শুরু করেন। শুনেছি, আড্ডার বন্ধুরাও পিছু নিয়েছিলেন তাঁর। একই চেনা মানুষ, একই চায়ের স্বাদ, শুধু ভেন্যুটার বদল হয়েছিল। শেষ জীবনে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত অরুণ দাশগুপ্তকে (অনেকেই তাঁকে ‘দামণি’ বলে ডাকতেন) ঘিরে আড্ডার কোলাহল থামেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন ১৯৭৫ সালে। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় জাতির জনককে হত্যা করে স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নীতিগুলোকেই যেন হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। এই ক্ষোভ ও বেদনা তখন ছাইচাপা আগুন হয়ে ফুঁসছিল কবি-লেখকদের মনে। সামরিক শাসনামলে অনেক অনুচ্চারিত কথাই জমে জমে পাথর হয়ে উঠছিল। প্রথম দিকে ইঙ্গিতে, উপমা-প্রতীকের ব্যবহারে কবিরা বঙ্গবন্ধু হত্যার নিন্দা জানাচ্ছিলেন সারা দেশ জুড়ে। ধীরে ধীরে সেই আড়ষ্টতাও কাটিয়ে উঠলেন তাঁরা। সরাসরি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে, ঘাতকদের ধিক্কার জানিয়ে লিখতে শুরু করলেন। আরও একবার জ্বলে উঠল বর্ণমালা। সেই অবরুদ্ধ সময়ে, ১৯৭৮ সালে মিনার মনসুর ও দিলওয়ার চৌধুরীর সম্পাদনায় চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয় ‘এপিটাফ’ নামের একটি ছোট কাগজ। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে ছিল শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি এবং ঠিক তাঁর মৃত্যু দিবসেই (১৫ আগস্ট) প্রকাশিত হয়েছিল ‘এপিটাফে’র এ সংখ্যাটি। এরপর এ-পত্রিকার ৫-৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৯ সালে ‘এপিটাফ’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘ শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ নামের সংকলন, যা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পর প্রকাশিত গুটিকয়েক সংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
আসলে ‘এপিটাফ’ গোষ্ঠী আন্দরকিল্লা সিরাজদ্দৌলা রোডের ‘মান্নান সওদাগরের চায়ের দোকানে’ আড্ডা দিতে শুরু করে ১৯৭৬ সাল থেকে। রাজনীতি-সচেতন এই তরুণদের কয়েকজন সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তাঁরা লেখালেখিও চালিয়ে গেছেন। মিনার মনসুর, দিলওয়ার চৌধুরী, নাজিম হাসান, খালিদ আহসান ও শাহেদ তৈমুর প্রমুখ ছিলেন এই আড্ডার নিয়মিত শরিক; মাঝে মাঝে এসে যোগ দিতেন জামাল রাজা, ইউসুফ মুহাম্মদ, মঈনুদ্দিন মঈনু প্রমুখ কবি-ছড়াকার-শিল্পীরা।
আশির দশকের শুরুর দিকে শহরের অন্য প্রান্তে চকবাজারের ‘সবুজ হোটেলে’ জমে উঠেছিল এক ঝাঁক সৃষ্টিশীল তরুণের আড্ডা। হাফিজ রশিদ খান, কাজী আইয়ুব, সোহেল রাব্বী, এজাজ ইউসুফী, মহীবুল আজিজ, রাশেদ মাহমুদ, সাজিদুল হক, রিজোয়ান মাহমুদ, পুলক পাল, শ ম বখতিয়ার, সুজন বড়ুয়া, জিল্লুর রহমান, সোহেল রাব্বী, হাবীব আহসান, আহমেদ রায়হান প্রমুখ কবি, লেখক ও লিটল ম্যাগাজিন কর্মীর নিয়মিত আসা-যাওয়ায় প্রতিদিন ঝড় উঠত চায়ের কাপে; আর রাজা-উজির মারার ফাঁকে নিত্য নতুন পরিকল্পনাও বেরিয়ে আসত। ‘শামা’, ‘আলোকসম্পাত’, ‘লিরিক’, ‘পুষ্পকরথ’, ‘সুদর্শন চক্র’, ‘সমুজ্জ্বল সুবাতা’স, ‘চম্পক নগর’,‘ লিটল ম্যাগাজিন’,‘ হৃৎপিন্ড’ প্রভৃতি বেশ কিছু ছোট কাগজ তখন প্রকাশিত হয়েছিল এখানকার আড্ডারুদের উদ্যোগে। সবাই এক বা একাধিক টেবিলে বসে আড্ডা দিলেও, এবং অনেক বিষয়ে নিজেদের মধ্যে চিন্তাভাবনার সাদৃশ্য থাকলেও সবাই ঝাঁকের কই ছিলেন না বলাই বাহুল্য। তাই কখনো একমত হয়ে কোনো কোনো উদ্যোগে যুক্ত হয়ে, আবার ভিন্নমত পোষণ করে মুক্ত হওয়ার উদাহরণও এখানে বিরল নয়। সবুজ আড্ডা যে সত্যিকার অর্থেই প্রাণের মেলা হয়ে উঠেছিল তার দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘পুষ্পকরথ’ পত্রিকার সবুজ আড্ডার ওপর বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ কিংবা ১৯৯৪ সালে সবুজ আড্ডার যুগপূর্তি উপলক্ষে সবুজ হোটেলকে ঘিরে রীতিমতো জাঁকালো অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা উল্লেখ করা যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযাদের ভুলব না
পরবর্তী নিবন্ধরায়পুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুন্নবীর ইন্তেকাল