দেশব্যাপী করোনা সংক্রমণ দিন দিন বাড়তে থাকায় গত ১ জুলাই থেকে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে সরকার। প্রথম দফায় ৭ দিনের জন্য এ বিধি-নিষেধ আরোপ করলেও পরবর্তীতে তা আরো ৭ দিন বাড়ানো হয়েছে। এরইমধ্যে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ পরবর্তী ৯ দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু সারাদেশের পাশাপাশি চট্টগ্রামেও সংক্রমণ ঊর্ধ্বগামী। বরং প্রতিদিনই রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় আগের দিনের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ৯ দিনে চট্টগ্রামে পঞ্চাশেরও অধিক আক্রান্তের মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ নতুন করে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে।
১৫ দিন আগেও চট্টগ্রামে করোনা শনাক্তের হার ২০ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই সময়ে শনাক্তের গড় হার প্রায় ৩৫ শতাংশে ঠেকেছে। কোনো কোনো দিন এই হার ৩৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে রোগীর চাপও বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। বিশেষ করে গত বেশ কিছু দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা উল্ল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা (কেবিন) সংখ্যা বাড়িয়েও চাপ সামালে হিমশিম অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতাল। সরকারি হাসপাতালগুলোও রোগীতে ভরে উঠছে। আইসিইউ শয্যা খালি-ই থাকছে না। এরইমধ্যে আইসিইউ সংকটে হাহাকারের পুরনো চিত্র যেন ফিরে এসেছে। কিন্তু সংক্রমণ ঠেকানো না গেলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে শঙ্কা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টদের। গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় এবার এ শঙ্কা আরো বেশি প্রকট হয়েছে।
কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের ৯ দিন পার হলেও এখনো ইতিবাচক কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেছেন সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বিও। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে মানুষের মুভমেন্ট (চলাফেরা) বন্ধ রাখা সম্ভব হলে এক সপ্তাহ পর এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়। কিন্তু এক সপ্তাহের বেশি অতিবাহিত হলেও এখনো তেমন ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছেনা। বরং সংক্রমণ যেন আরো বাড়ছে। শুক্রবার (গতকাল) কয়েকটি ল্যাব বন্ধ থাকার দরুন এই ২/১ দিনেও পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবেনা। পরিস্থিতি কোনো দিকে যাচ্ছে, তার স্পষ্ট চিত্র পেতে আমাদের হয়তো আরো কয়দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে যা-ই হোক, সংক্রমণ ঠেকাতে হলে মাস্ক পরা নিশ্চিতের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে জানিয়ে জনসধারণকে আরো বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী- কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের প্রথম দিন (গত ১ জুলাই) চট্টগ্রামে পরীক্ষাকৃত নমুনায় করোনা শনাক্তের হার ছিল ২৬.৭৭ শতাংশ। ওই দিন মোট ২ হাজার ৬২ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৫৫২ জনের করোনা শনাক্ত হয়। মৃত্যু হয় ৫ জনের। এরপর থেকে সংক্রমণের হার যেন বেড়েই চলেছে। ২ জুলাই শনাক্তের গড় হার দাঁড়ায় ৩৪.১৭ শতাংশে। ৩ জুলাই শনাক্তের হার কিছুটা কমে ২৫ শতাংশে ঠেকলেও এরপর থেকে শনাক্তের গড় হার ৩৩ শতাংশের বেশি। সর্বশেষ ৯ জুলাই শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৩৭.২৮ শতাংশে। এর আগে ৭ জুলাই পরীক্ষাকৃত নমুনায় ৩৭.৩৯ শতাংশের করোনা শনাক্ত হয় চট্টগ্রামে। ওই দিনের (৭ জুলাই) শনাক্তের এই হার চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে এ যাবত সর্বোচ্চ। হিসেবে বিধি-নিষেধ প্রতিপালনের এই সময়েও চট্টগ্রামে করোনা শনাক্তের গড় হার প্রায় ৩৫ শতাংশ।
কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের আগেই গ্রামাঞ্চলসহ সংক্রমণ সবখানে ছড়িয়ে পড়ে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া। এই চিকিৎসকের অভিমত- কঠোর বিধি-নিষেধের যে পদক্ষেপ, তা এসেছে অনেকটা দেরিতে। এই পদক্ষেপের (কঠোর বিধি-নিষেধ জারির) আগেই সংক্রমণ যা ঘটার ঘটে গেছে। এবার তো গ্রামাঞ্চলেই সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া দিনে আনে দিনে খায় গোছের পরিবারগুলোর ঘরে-ঘরে খাবার পৌঁছাতে না পারলে বিধি-নিষেধ যত কঠোরই হোক, তা শতভাগ কার্যকর করা কঠিন। যার কারণে কঠোর বিধি-নিষেধেও ইতিবাচক তেমন ফলাফল দেখা যাচ্ছেনা। সরকারের আরো আগে থেকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন ছিল বলেও মন্তব্য করেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া। তবে উত্তরাঞ্চলে সংক্রমণ এখন নিম্মমুখী জানিয়ে সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, সংক্রমণের ঢেউ এখন দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ভর করেছে। আরো কিছু দিন হয়তো এর প্রভাব থাকতে পারে। ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে হলে মাস্ক পরা নিশ্চিতের পাশাপাশি সকলকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সিভিল সার্জন।