বাজারটির নাম আন্ধারিঝাড়। বাজারের পাশেই বড় একটি কাঠ বাগান। কাঠ বাগানের এক পাশে ছোট একটি বাঁশের ঝাড়। বাঁশ ঝাড়ের সাথেই একটি খাল। খালটিতে প্রায় সারা বছরই কমবেশি পানি থাকে। সেই পানিতে কিছু দেশীয় মাছ, সাথে ব্যাঙ ও কিছু কচ্ছপ বসবাস করে। কাঠ বাগানে অনেক পাখপাখালি বাস করে, তাদের সাথে বেশ কিছু বানরও বসবাস করে। বানর গাছে গাছে লাফিয়ে গাছের কচি কচি পাতা খেয়ে জীবনধারণ করে। মাঝে মাঝে সুযোগ বুঝে বানরগুলি মানুষের কলাবাগান থেকে আধাপাকা কলা নিয়ে এসে খায়। আর আম কাঁঠালের দিনে চট করে দৌড় মেরে কারো গাছের পাকা আম কাঁঠালও নিয়ে এসে কাঠবাগানে বড় গাছের উপরে বসে বসে খায়। বানর সাধারণতো বাচ্চা দেয়ার সাথে সাথেই সে সকল বাচ্চা দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি করা শুরু করে মনে হয় যেনো বানরের বাচ্চা তাদের মায়ের গর্ভ থেকেই গাছে উঠা এবং গাছে গাছে দৌড়ানোর টেনিং শেষ করেই ভূমিষ্ঠ হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরেই সেই টেনিং কাজে লাগায়। অনেক সময় দেখা যায় গর্ভবর্তী বানর গাছের ডালেই বাচ্চা প্রসব করে। প্রসব করার সাথে সাথে বাচ্চা টুপ করে গাছের ডাল ধরে দোল খাওয়া শুরু করে। একদিন সকাল বেলা এক বানর গাছে উঠে কচি পাতা খাওয়া শুরু করে। গাছের মোটা এক শাখার চিপায় দু‘টি বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চা দু‘টি জন্মানোর সাথে সাথেই সেই টুপ করে গাছের শাখা ধরে দুলতে থাকে। এমন করে দুলতে দুলতে হঠাৎ করে একটি বাচ্চা গাছের নিচে পড়ে যায়। গাছের নিচেই একটি কচ্ছপ আগে থেকেই মাটি খুড়ে গর্ত করে তাতে ডিম দিচ্ছিলো। কচ্ছপটির ডিম দিতে গিয়ে পেটে খুব ক্ষুধাও পেয়েছিলো। এমন সময় বাননের একটি বাচ্চা কচ্ছপটির পিঠের উপর ঢুব্বুস করে পড়ে যায়। সে তখন হকচকিয়ে উঠে বলে কে রে, তুই! আমার ডিম চুরি করতে এসেছিস? এই বলে কচ্ছপটি বানর ছানার এক পা কামড়ে ধরে। ছানাটি মা মা বলে চিৎকার করে আর কচ্ছপকে বলে, ও কাট্টু মা আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। আমি তোমার ডিম চুরি করতে আসিনি হঠাৎ করে গাছ থেকে তোমার উপরে পড়ে গেছি গো কাট্টু মা! কচ্ছপটি বলে না না আমার পেটে অনেক ক্ষুধা আমি তোকে খেয়ে নিব। এদিকে মা বানরটি তার জামাইকে সাথে নিয়ে সেই কচ্ছপের কাছে এসে দেখে তাদের বাচ্চা খুব কান্নাকাটি করছে আর কচ্ছপের মুখ থেকে ছুটে যাওয়ার জন্য ছোট্ট প্রাণে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু কচ্ছপ কোনো মতেই ছাড়ছে না। বানর দম্পতি এসেই এক ধমক দিয়ে বলে কে রে, তুই আমাদের বাচ্চা ধরে খুব বাহাদুরি করছিস? কচ্ছপ এবার টের পেয়ে মনে মনে বলে ওরে বাবারে, এতো দেখছি বিখ্যাত দুষ্টদের বাচ্চা! এবার তো মহাবিপদে পড়ে গেলাম! এই ভেবেই কচ্ছপ বানর ছানাটি ছেড়ে দিয়ে বলে আসলে আমি চিনতে পারিনি। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দাও। অনাহারেই ডিম দিতে শুরু করেছিতো তাই গন্ডগোল হয়ে গেছে। পেটের ক্ষুধায় এলোমেলো হয়ে গেছি। এবার বানর দু‘টি বলে না না, তোকে ক্ষমা করা যাবে না। তোর কঠিন শাস্তি হবে। তুই আমাদের কলিজার টুকরো বাচ্চাটি কামড়ে দফারফা করেছিস! এই বলে পুরুষ বানরটি কচ্ছপটিকে খামচি মেরে উল্টে ফেলে একটি পা ধরে গাছের উপরে উঠে গাছের শাখার এক চিপায় রেখে গাছের মরা ডাল দিয়ে পিঠে পেটাতে থাকে। অনেক সময় পেটানোর পর বানরের হাতের ডাল ভেঙ্গে গুড়া গুড়া হয়ে যায়। সেই সাথে বানরটি ঘেমে চুপচুপা হয়ে যায়। এদিকে কচ্ছপ মাথা নিচের দিকে দিয়ে মনে মনে মিটমিট করে হাসে, আর মনে মনে বলে তোমার এমন মরা ডালের পিটুনিতে শুধু আমার পিঠের সুরসুরি মরতে পারে। কিন্তু বানর হাল ছাড়বার পাত্র নয়, সে বলে এভাবে ওর শাস্তি হবে না। এই কচ্ছপকে গাছের উপরে তুলে নিচে ফেলে মারতে হবে। এ কথা শুনে স্ত্রী বানরটি বলে তাতেও কাজ হবে মনে হয়। এই পাঁজিটার পিঠতো লোহার মতো শক্ত। উপর থেকে ফেললে ওর কিছুই হবে না। পুরুষ বানরটি কিছু সময় চিন্তা করে বলে আচ্ছা, একে নিচে নামিয়ে শুকনো কাঠ খড় জমা করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে সেই আগুনে ফেলে দিলেইতো একেবারে খেলা শেষ! স্ত্রী বানরটি বলে এটাও খারাপ হয়না। তবে আমার কাছে আরো একটি বুদ্ধি ঘুরপাক করছে। পুরুষ বানরটি বলে তা হলে বলে ফেলোতো তাড়াতাড়ি গিন্নী। কেমন বুদ্ধি তোমার মাথায় জটলা করছে শুনি। আর যেহেতু তুমি ছানাদের পেটে ধারণ করেছো, অনেক কষ্ট করে তাই তোমার বুদ্ধিটাই শোনা উচিত। এবার বানর বধু বলে ওকে যা তা শাস্তি দিলে হবে না, ওকে বড় বট গাছের উপর থেকে নিচে ফেলে মারতে হবে। আর যেখানে ফেলবে সেখানে আগে থেকেই কিছু খুব পোড়া ইট রেখে দিতে হবে। আর তার উপরে ফেলে একেবারে গুঁড়াগুঁড়া করতে হবে। এটার পরিবর্তে আরো একটি বুদ্ধি আছে। ঐযে দেখা যায় ফুল কুমার নদী। চলো না হয় নদীতে নিয়ে একেবারে পানিতে ফেলে দেই! পানিতে ফেলে দিলে পানি খেতে খেতে পেট ফুলে একেবারে ফুটবল হয়ে পানিতেই ঠুস করে মরে ভেসে যাবে! এসব কথা শুনে কচ্ছপ বলে আমার একটি শেষ ইচ্ছা তোমরা রাখবে দয়া করে। এই দুনিয়াতে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিদেরও শেষ ইচ্ছা রাখে। এবার পুরুষ বানরটি বলে আচ্ছা বল দেখি তোর কি শেষ ইচ্ছা। তখন কচ্ছপ হাত জোর করে বলে তোমরা আমাকে যে ভাবে মারতো চাও তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। গাছের উপর থেকে ফেলে অথবা আগুনে পুড়ে ভস্ম করলেও আপত্তি নেই মোটেই। তবে দয়া করে আমাকে নদীতে ফেলবে না! নদীতে এখন খুব খারাপ পানি, এমন পচা দুর্গন্ধযুক্ত পানি আমি খেতে পারব না। এই পানি খেলে আমার পেটে কঠিন পীড়া হয়ে ব্যথায় ভুগে ভুগে মরতে হবে। এই কথা শুনেই বানর বধূ বলে এবার আসল খবর পেয়ে গেলাম! এই বলে স্ত্রী বানরটি খুশি হয়ে নেচে নেচে তার জামাই বাবুকে বলে–চলো চলো জলদি চলো। এবার এই দুষ্ট কচ্ছপটিকে ফুল কুমার নদীর জলে ফেলেই ওর জীবনের সমাপ্তি করতে হবে। এই বলে দুজনে ধরাধরি করে কচ্ছপটি নিয়ে ফুল কুমার নদীতে নিক্ষেপ করে! নিক্ষেপ করার সাথে সাথে কচ্ছপটি বলে। টা টা! বোকা বানর এবার ফিরে যা! এবার আমার বাজিমাত! এই বলে কচ্ছপটি মনের আনন্দে নদীতে সাঁতার কেটে মনের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে ফেলে।