পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বাদুড় নামে পরিচিত সোনালী মাথার দৈত্য বাদুড় বা ‘জায়ান্ট গোল্ডেন–ক্রাউন্ড ফ্লাইং ফক্স’ এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কক্সবাজার শহর ও শহরতলী। ‘প্রকৃতির ফরেস্টার’ নামে পরিচিত এই প্রাণীটির বিচরণ বৃদ্ধির ঘটনা কক্সবাজার শহর ও শহরতলীর বাস্তুতন্ত্রের জন্য একটি বড় সুসংবাদ বলে মনে করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। স্থানীয়রা জানান, সামপ্রতিককালে কক্সবাজার শহর ও শহরতলীতে সোনালী মাথার দৈত্য বাদুড় বা ‘জায়ান্ট গোল্ডেন–ক্রাউন্ড ফ্লাইং ফক্স’ এর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। শহরের টেকপাড়া ও বইল্লাপাড়া এলাকার বড় বড় গাছে শতাধিক দৈত্য বাদুড় কলোনি তৈরি করে বসবাস করছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওরা খাবারের সন্ধানে যখন দল বেঁধে বের হয় তখনই ওদের দেখতে পাওয়া যায় বলে জানান শহরের বইল্লা পাড়ার বাসিন্দা হেলালউদ্দিন কন্ট্রাক্টর। তিনি জানান, সূর্য ডোবার পর পরই ডজনকে ডজন দৈত্য বাদুড় পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে উড়ে যেতে দেখা যায়। শহরের গোলদিঘির পাড়, ক্যাংপাড়া, বইল্লাপাড়া ও দক্ষিণ টেকপাড়ার বড় বড় গাছে দিনের বেলায় এরা ঘুমিয়ে থাকে। আর সন্ধ্যা হলেই দলে দলে বের হয়।
শহরের টেকপাড়া এলাকার বাসিন্দা মাঈনুদ্দিন শাহেদও প্রতিদিন অসংখ্য দৈত্য বাদুড়ের দেখা পান, যা আগে দেখা যায়নি বলে তিনি জানান। শহরতলীর দরিয়ানগর এলাকার বাসিন্দা গৃহিনী মস্তরা আকতার বলেন, আমাদের পেয়ারা গাছে পাকা পেয়ারা খাওয়ার জন্য গত প্রায় দেড় মাস ধরে বেশ কয়েকটি সোনালী মাথার দৈত্য বাদুড় রাতের বেলায় আসে। যা অন্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি। চলতি বছর কক্সবাজার শহরে এই দৈত্য বাদুড়ের সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
সামপ্রতিকালে দৈত্য বাদুড়ের বিচরণ বৃদ্ধির ঘটনা এখানকার বাস্তুতন্ত্রের জন্য একটি বড় সুসংবাদ বলে মনে করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বাদুড় পরিবেশের বা বাস্তুতন্ত্রের জন্য ‘কি স্টোন’ প্রজাতি হিসাবে বিবেচিত। এটি পরিবেশের জন্য এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রাণিটি না থাকলে কলা, আমসহ অন্তত কয়েকশ প্রজাতির উদ্ভিদ হারিয়ে যাবে এবং একটি বাস্তুতন্ত্রই পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া জানান, বাদুড়ই পৃথিবীর একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণি, যারা উড়তে পারে। পৃথিবীতে প্রায় ১,৪০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রজাতির বাদুড় হল সোনালী মাথার দৈত্য বাদুড় বা ‘জায়ান্ট গোল্ডেন–ক্রাউন্ড ফ্লাইং ফক্স’; যেটি স্থানীয় ভাষায় ‘কেলা বাঁদুর’ বা কলা বাদুড় নামে পরিচিত। এরা মূলত ফলভোজী। এরা পেয়ারা, কলা ও বিভিন্ন ধরনের ডুমুর এবং কিছু পাতা খায়। আবার সেই ফলের বীজ তার বিষ্ঠার মাধ্যমে বহু দূরে ছড়িয়ে দিয়ে বন বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখে। এছাড়া সে যখন একটার পর একটা গাছের ফুল থেকে নেকটাস বা অমৃত পান করে তখন সেই ফুলের রেণু অন্য ফুলে ছড়িয়ে পড়ে এবং এভাবে পলিনেশন বা ফুলের পরাগায়ণে সহায়তা করে। ফলে তাকে প্রকৃতির ফরেস্টারও বলা যায়। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণি।
তিনি জানান, এই প্রাণিটির প্রাণিতাত্ত্বিক নাম অ্যাসারোডন জুবেটাস। প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত এরা বাচ্চা দেয় এবং স্ত্রী বাদুড়েরা একবারে একটি করে বাচ্চা দেয়। এই প্রজাতির নথিভুক্ত বাদুড়ের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ বাদুড়ের দৈর্ঘ্য ২১ সেমি বা ৮.৩ ইঞ্চি। এটি রাতে খাবার খুঁজে পায় এবং দিনের বেলা গাছের বাসায় ঘুমায়। এই বাসাগুলিতে হাজার হাজার বাদুড় থাকতে পারে। ড. কিবরিয়া জানান, ১৮৩১ সালে বর্ণনার পর থেকে এর তিনটি উপ–প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে এ জুবেটাস লুসিফার নামের একটি প্রজাতি ইতোমধ্যে একটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানান, ‘জায়ান্ট গোল্ডেন–ক্রাউন্ড ফ্লাইং ফক্স’ বা কেলা ‘বাঁদুর’ এর বৃহৎ আকার এবং গতিশীলতা তাদেরকে নির্দিষ্ট উদ্ভিদ প্রজাতির জন্য কার্যকর পরাগায়নকারী করে তোলে, বিশেষ করে যেসব উদ্ভিদের ফুল বড় এবং ছোট প্রাণীদের পক্ষে অ্যাক্সেস করা কঠিন। এই পরাগায়ন বিভিন্ন উদ্ভিদের প্রজনন সাফল্যে অবদান রাখে, যার মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতিও রয়েছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিম বলেন, ৩০০ টিরও বেশি প্রজাতির ফল পরাগায়নের জন্য বাদুড়ের উপর নির্ভর করে। চরম মরুভূমি এবং মেরু অঞ্চল ছাড়া পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অংশেই বাদুড় পাওয়া যায়। বাদুড় না থাকলে আম, কলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রজাতির ফল বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাদুড় বাদাম, ডুমুর এবং কোকোর বীজ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে – যা চকোলেটের প্রধান উপাদান। বাদুড় না থাকলে আমাদের কাছে অ্যাগেভ বা আইকনিক সাগুয়ারো ক্যাকটাসের মতো গাছপালাও থাকত না।
ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডাব্লিইসিএস) কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বন উজাড় এবং চোরাশিকারের কারণে দৈত্য আকৃতির বাদুড় একটি বিপন্ন প্রজাতি। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন এই প্রজাতির শিকার এবং ব্যবসাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আরো জানান, রাতের পোকামাকড় সবচেয়ে ভয় পায় বাদুড়কে। এরা প্রতিদিন তাদের শরীরের ওজনের প্রায় সমান পোকামাকড় খেয়ে থাকে। এরফলে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এরা অবদান রাখে। শুধু তাই নয়, বাদুড় এখন বিজ্ঞানের নানা শাখাকে পথ দেখাচ্ছে। প্রায় ৮০টি ওষুধ এমন উদ্ভিদ থেকে আসে যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য বাদুড়ের উপর নির্ভর করে। তবে বাদুড় অন্ধ নয়। বাদুড় কীভাবে প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে তা অধ্যয়নের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অন্ধদের জন্য নেভিগেশনাল এইড তৈরি করছে।