অবিলম্বে ধ্বংসযজ্ঞ, নৈরাজ্য
শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে গত সোমবার তাঁর সরকারের পতন ঘটেছে। ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। হাসিনা সরকারের পতনের পর এমন ছাত্র–জনতার কল্লোল আগে কেউ দেখেনি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বিভিন্ন জায়গায় থানা, আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের ঘরবাড়ি, সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘দেশজুড়ে সৃষ্টি হওয়া গণজোয়ারের মধ্যে দেখা গেছে, একশ্রেণির লোক বেপরোয়া, নিয়ন্ত্রণহীন ও সুযোগসন্ধানী। ক্ষোভ মেটাতে সরকারি–বেসরকারি স্থাপনা, মন্ত্রী–এমপিসহ সরকারি দলের অনেক নেতার ঘরবাড়ি, স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। একশ্রেণির বিক্ষুব্ধ মানুষ গণভবন ও জাতীয় সংসদের ভেতরে ঢুকেও বিশৃঙ্খলা চালিয়েছে। যে যা কিছু পারে, সেখান থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হচ্ছে, কিছু জায়গায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরও আক্রান্ত হয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক ও হতাশাজনক। এটি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কয়েক দিন ধরে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকেও সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয় রক্ষার ব্যাপারে বারবার সতর্ক থাকার কথা বলা হচ্ছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম, উত্তেজিত বা সুযোগসন্ধানীরা এমন ঘৃণিত ও নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডেই লিপ্ত হয়েছে।’
থানা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটেছে। ফলে থানাগুলোতে পুলিশের উপস্থিতি নেই। সড়কে নেই ট্রাফিক পুলিশও। আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সঙ্গে বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও আনসার সহায়তা করছে। এদিকে, পুলিশের সদস্য ও পুলিশের স্থাপনায় আক্রমণ না চালানোর অনুরোধ জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ–আল–মামুন। মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগ থেকে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় আইজিপি এ আহ্বান জানান। আইজিপি বলেন, পুলিশের সদস্য ও পুলিশের স্থাপনাগুলোতে আক্রমণের ঘটনা সংঘটিত না করার বিষয়ে রাজনৈতিক নেতা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যেন সবাইকে আহ্বান জানান। পুলিশ সদস্যদের দৃঢ় মনোবল ও নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দায়িত্ব পালনের অনুরোধ জানিয়ে আইজিপি বলেন, ‘বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যবৃন্দের উত্থাপিত বিভিন্ন সমস্যা এবং দাবির যৌক্তিক সমাধানকল্পে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হচ্ছে। পুলিশের সকল সদস্যকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে ধৈর্যসহকারে নিজের নিরাপত্তা বজায় রেখে দায়িত্ব পালনের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। আশা করছি, সকলের সহযোগিতায় দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।’ সাধারণ মানুষের কাছে তাদের আবেদন, কিছু মানুষের অন্যায় কাজের শাস্তি দয়া করে পুরো পুলিশ বাহিনীকে দেবেন না। যাঁরা অপরাধ করেছেন, তাঁরা শাস্তি পাক। কিন্তু নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দেওয়া, হত্যা করা আরেকটি অন্যায়। বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক না কেন, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করাটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দসহ জামায়াতে ইসলামীও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এক বার্তায় বলেছেন, আমরা সবাইকে শান্ত থাকতে এবং শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করছি। যাঁরা ঢাকায় আসতে পারছেন না, তাঁরা নিজ নিজ এলাকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিন। রাজপথে অবস্থান নেওয়া ছাত্র–জনতার উদ্দেশে লুটপাটকারীদের রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, একটি সুবিধাবাদী দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী বিভিন্ন স্থানে সরকারি স্থাপনা, প্রতিপক্ষের বাড়িঘর এবং ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করছে। তিনি এর নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ‘গতকালই আমরা উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছি, আজকে আবারও আমরা জাতিকে আহ্বান জানাব, যেখানেই দুর্বৃত্তপনা দেখবেন, তৎক্ষণাৎ এদের প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা কথা দিচ্ছি, বিদ্যমান প্রশাসনকে এ বিষয়ে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।’
আন্দোলনের বিজয়কে ধরে রাখতে হলে অবিলম্বে ধ্বংসযজ্ঞ, নৈরাজ্য ও ভাঙচুর বন্ধ করতে হবে। কারও হঠকারিতায় আন্দোলনের বিজয় যেন বেহাত না হয়– এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির যে ঘটনা ঘটেছে, যা দুঃখজনক এবং কোনোভাবে কাম্য নয়। চলমান ক্রান্তিকালে রাষ্ট্র–শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি হয়ে পড়েছে।