বাংলাদেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে ১৫০ টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের শিক্ষার মান ও পরিবেশ নিয়ে দেশে নানাবিধ আলোচনা সমালোচনা কমবেশি হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সূচকে অগ্রগতি অর্জন করছে তখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংএ কতটুকু এগিয়েছে তা আজকের লেখায় একটু পর্যালোচনা করতে চাই।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিউ এস লিমিটেড( কোয়াকুয়ারেলি সাইমন্ডস লি.) বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং ২০২৩ প্রকাশ করেছে। ৮ জুন ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত এ তালিকায় ১৪০০ টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। বৈশ্বিক এই বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শীর্ষ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায়নি। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক দুর্বল হলেও ঐ শীর্ষ ৫০০ টির মধ্যে তাদের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ঐ তালিকায় ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে স্থান পেয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতির মধ্যেও শিক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের এ দুরবস্থা কেন? এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা ও গবেষণা প্রয়োজন। এখন দেখা যাক বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতটুকু পিছিয়েছে এবং কেন পিছিয়েছে?
কিউ এস এর ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের র্যাঙ্কিং তালিকায় শীর্ষ ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় সহ মোট ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছিল। সেই তালিকায় ১ নং এ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কেমব্রিজে অবস্থিত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বা এমআইটি। আর ঐ তালিকায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ছিল ১২৭ তম তে, বুয়েট বা বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ছিল ১৭৫তম তে। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল যে, কিউ এস এর প্রতিবছরের এই গবেষণা জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে বৈশ্বিক মানদণ্ডে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, কিউএস এর ওয়ার্ল্ড রাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ছিল ১০৯ তম স্থানে, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে নিচে নেমে হল ১২৪ তম, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে আরো নিচে নেমে হল ১২৭ তম। সর্বশেষ ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের প্রকাশিত তালিকায় দেখা যায় চরম পতন। এই তালিকার প্রথম ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।
কুয়াকুয়ারেলি সাইমন্ডস বা কিউ এস প্রতিবছর কিছু আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে। এসব মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে: প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য, শিক্ষক কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সাফল্য, শিক্ষার্থীদের সাফল্য, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশন, পিএইচডির সংখ্যা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপাত, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী বিনিময় হার ইত্যাদি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাঙ্কিং এ বারবার পিছিয়ে পড়ছে কেন? এবারের কিউএস এর তালিকায় শীর্ষে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এম আই টি। এটি মূলত একটি গবেষণা নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া শীর্ষস্থানীয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্রের কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, স্ট্যান্ডফোরড বিশ্ববিদ্যালয়, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি; যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তাদের তথ্য যাচাই করলে দেখা যায় এদের বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় হয় গবেষণায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিজেকে গবেষণায় সম্পৃক্ত করে। বিশ্বকে নতুন নতুন উদ্ভাবন দিয়ে সমৃদ্ধ করে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। অথচ উচ্চ শিক্ষার বৈশ্বিক প্রবণতার অনেকটা উল্টো পথে চলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের দেখভাল করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি। ইউজিসির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা হয় না। গবেষণার পরিবর্তে চলে মুখস্থ নির্ভর গদ বাধা পড়ালেখা, যার মূল লক্ষ্যই চাকরি–বাকরি। শিক্ষার্থীরা গবেষণা করবেন, নতুন নতুন উদ্ভাবন করবেন, জাতিকে বিশ্ব দরবারে মেলে ধরবেন এমনটাই হওয়া উচিত দেশের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল লক্ষ্য। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমূহে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাতে আন্তর্জাতিক রীতি অনুসরণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পলিসি করে বিদেশি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী আসার সুযোগ করে দিতে হবে। নিম্নমানের শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করতে হবে, শিক্ষকদের পিএইচডি গবেষণা ও আন্তর্জাতিক প্রকাশনা প্রমোট করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধির জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সাথে বিশেষ করে ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যোগাযোগ পরিকল্পিতভাবে বাড়াতে হবে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিত্য নতুন উদ্ভাবনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের ওয়েবসাইট আপগ্রেড হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সমূহকে আরো মনোযোগ দিতে হবে। দেশে বিদেশের সুনাম বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের দলাদলি, সেশনজট, ছাত্র রাজনীতির হাঙ্গামা ইত্যাদি নেগেটিভ সংবাদ থেকে বের হয়ে এসে গবেষণা, প্রকাশনার নতুন নতুন খবর গুলো যেন সংবাদ মাধ্যমে তথা গণমাধ্যমে বেশি বেশি প্রচার পায় তা খেয়াল রাখতে হবে। ইউজিসি চাইলে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দবৃদ্ধি এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক বিদেশে ফ্যাকাল্টি বা শিক্ষক নিয়োগে আইনের কড়াকড়ি করতে পারে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে বেশি বেশি ভিজিটিং প্রফেসর এবং বিদেশী শিক্ষার্থীর আগমনের সুযোগ করে দিলে বিশ্ব র্যাঙ্কিং এ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে যেতে পারবে।
সবশেষে বলতে চাই, সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে কয়েকটি বিষয় যেমন, একাডেমিক সুনাম বা খ্যাতি, চাকরির বাজারে সুনাম, বিশ্ব স্বীকৃত শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত অনুসরণ, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং বিদেশি শিক্ষক ও বিদেশী শিক্ষার্থী আনায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে আশা করা যায় আগামীতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং এ ভালো অবস্থান নিশ্চিত করতে পারবে।
লেখক: অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কায়সার নিলুফার কলেজ ও
প্রধান উপদেষ্টা, রাজনীতি বিজ্ঞান অনুশীলন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম।