ওষুধ সমাচার এবং শিশু ও প্রসূতির মৃত্যু

ডা. দুলাল দাশ | সোমবার , ১৩ মে, ২০২৪ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

ওষুধে বাঁচায়ওষুধে মারে’এই প্রবাদ বাক্যটি সর্বজনবিদিত। রোগ নিরাময়ে একমাত্র উপায় চিকিৎসা এবং ওষুধের প্রয়োগ ও ব্যবহার। আজ এবং আগেও ছিল সেই ওষুধ নিয়ে অভাবনীয় ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। যার ফলে শিশু ও প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে। মানুষের মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর আশু সমাধান দরকার। নকল ভেজাল ওষুধের কারণে মানুষ খোয়াচ্ছে অর্থসম্পদ, রোগীদের ভোগান্তি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। চিকিৎসকেরা পড়ছে বিপাকে। রোগীরা বার বার ডাক্তারের নিকট ধর্ণা দিচ্ছে। একবার এ ডাক্তার ঐ ডাক্তার করছে। ডাক্তারদের প্রতি মানুষ বিশ্বাস হারচ্ছে। এই ঘটনাগুলো সামাজিক মিডিয়াতে প্রকাশ পাচ্ছে। দেশবাসী অসহায় ও অনিরাপদ বোধ করছে। দেশ ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধে সয়লাব। মনে হয় একমাত্র বাংলাদেশে ওষুধ নিয়ে অতি কারসাজি হয়। দেখুন একটা রোগী রোগমুক্তির জন্য ডাক্তারের নিকট পুরো আত্মসম্পর্ক করে। আর ওষুধ ব্যবসায়ীরা ভীষণ দায়িত্বহীনতা ও অমানবিক আচরণ করে। শুধু অর্থের লোভে এমনটা করে। নিম্নমানের ভেজাল, মেয়াদউত্তীর্ণ ওষুধ অহরহ বাজারে ঢুকছে। এইগুলো ধরার জন্য, গুণগত মান দেখার জন্য ভিজিলেন্ট টিম কাজ করছে। তবুও থামছে না। এ ব্যাপারে সরকারের আইন থাকলেও প্রয়োগ খুবই কম। তার মধ্যে নিশ্চই শিথিলতা আছে। মনে রাখা দরকার জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং খাদ্যে ভেজালকারীদের চীন দেশের মত আমাদের দেশেও কঠোর দণ্ড থাকা উচিত। নতুবা প্রতিনিয়ত ভেজাল ওষুধের কারণে রোগী মারা যেতে থাকবে। ওষুধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়া কেহই ওষুধের গুণগত মান ও ভেজাল বাহির করতে পারবে না। ১৯৮২ সালে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের ১১ () ধারায় স্পষ্ট বলা আছে সরকার গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ঔষুধের দাম নির্ধারণ করবে। অথচ এই নিয়মের তোয়াক্কা করা হয় না। অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে আন্দোলনে হৈ চৈ পড়ে যায়। ওষুধের বেলায় নেই। মাত্র কিছুদিন আগে ছেলের খৎনা করার জন্য তার বাবা একটা বেসরকারি ক্লিনিকে যায়। অপারেশনের সময় অ্যানাসথেটিক এজেন্ট হেলোথেন ওষুধটি ব্যবহার করা হয়। শিশুটি অপারেশন টেবিলে মারা যায়। অনুসন্ধানে দেখা গেল ওষুধটি নকল ছিল। বাবার বুকফাটা ক্রন্দন আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হলো। যারা শুনলো একটু হুফ করে উঠলো। তার পর তথৈবচ। পৃথিবী তার নিয়মে চললো। যার গেছে তার একশত ভাগ গেছে। খবরে প্রকাশ আন্ডোসকপি করতে গিয়ে ইনজেকশন পুশিং করার পর রোগীর জ্ঞান ফিরে আসেনি। নকল ও নিম্নমানে ওষুধের ব্যবহারের ফলে কিডনী, লিভার, হার্ট ও ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে। প্রশাসন অধীদপ্তরের মতে দেশে ২৮৭টি ওষুধ কোম্পানী আছে। তার মধ্যে ২০০টি উৎপাদনে আছে। আরও দুঃখজনক খবর হলো বড় বড় শহরের ওষুধের সাথে গ্রামের ওষুধের কোনও মিল নেই। গ্রামেগঞ্জে দরিদ্রজনগোষ্ঠি দোকানদারকে বলে কম দামে এই ওষুধগুলো খায়। অথচ যে দিচ্ছে তার জানা উচিত এই ওষুধে তার ক্ষতি হতে পারে। প্রায়ই শুনা যায় মেয়াদোত্তীর্ণ ভেজাল ওষুধ ধরার জন্য অভিযান চলে। ধরা পরার সাথে সাথে জরিমানা করা হয়। দোকান সীলগালা করা হয়, মামলাও হয়। তবুও এ অপরাধ থামছে না। ওষুধের দাম নিয়ে বলতে গেলে কিছুদিন পর পর বাড়ে। একটা কারণ হলো ডলারের মূল্য বৃদ্ধি। তারপরও গরীব জনগণের কথা ভাবা দরকার। এমন অনেক রোগী আছে তাদের দৈনিক একতিন হাজার টাকার ওষুধ সেবন করতে হয়। অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত লোকেরা উচ্চ মূল্যের কারণে ওষুধের কোর্স শেষ করতে পারে না বিধায় সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারে না। রোগী যদি ইমারজেন্সী হয় তবে তো রোগীর অত্মীয়রা চোখে মুখে অন্ধকার দেখে। সরকারি হাসপাতালে বরাবরের মতো বাইরে থেকে ওষুধ কিনে দিতে হয়। অসংখ্যা দরিদ্র রোগীরা না পারছে ডাক্তার দেখাতে না পারছে ওষুধ কিনতে। তাদের ভরসার স্থল সরকারি হাসপাতালগুলো অন্তত সেখানে যে যতই বলুক চিকিৎসা ও ওষুধের কিছু ব্যবস্থা আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. ,বি,এম আবদুল্লাহ বলেন ‘আমরা রোগীদের ওষুধ দিই কিন্তু কাজ হয় না। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নকল হলে রক্ষার পরিবর্তে জীবন কেড়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে দেশে যখন ওষুধের এ অবস্থা বিদেশে বাংলাদেশের ওষুধ সুনামের সাথে বিক্রি হচ্ছে। দেশ তোলপারশিশু ও প্রসূতিদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে। এই নিয়ে সামাজিক মিডিয়া এবং কর্তা ব্যক্তিরা সরগরম করছে। তদন্তেও নেমেছেন। মাত্র কিছুদিন আগে খতনা অপারেশন করতে গিয়ে পর পর কয়েকটা শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যু একেবারে অনভিপ্রেত। ছেলেকে বাবা আদর করতে করতে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকল। বেশ কিছুক্ষণ পর বাবা সেই ছেলেটাকে মৃত কোলে করে বের হলো। কী মর্মান্তিক দৃশ্য! এ দৃশ্য কার সহ্য হবে? কে দেবে তাকে সান্ত্বনা? এ ব্যাপারে সংস্লিষ্টদের আরও দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হওয়া উচিত ছিল। সবায় চাইবে এটার বিচার হোক। সুতরাং পুরো প্রক্রিয়াটা বিধি নিষেধের মধ্যে থাকুক এটাই কাম্য। মেয়াদোত্তীর্ণ, ভেজাল, লেভেল বদলানো ব্যবসায়ীদের শাস্তির বিধান থাকা দরকার। একইভাবে ঘটে যাচ্ছে প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুর মিছিল। তাদেরও অস্বাভাবীক মৃত্যু হচ্ছে গত দুই একমাস থেকে। প্রসূতিরা সাধারণত তীব্র প্রসব বেদনা নিয়ে হাসপাতালে, ক্লিনিকে ভর্তি হয়। কোনও কোনও সময় প্রসূতি ও মাতৃগর্ভে সন্তানের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তাদের উভয়কে বাঁচানোর জন্য ইমারজেন্সী সিজারিয়ান অপারেশন করতে বাধ্য হয়। আমরা বিটিভি সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারি সারাদেশে ১৬১৮ জন প্রসূতি অপারেশনের পর পোস্ট অপারেটিভে মৃত্যু হয়েছে। শুধু চট্টগ্রামে মারা গেছে ১১ জন। তদন্ত কমিটি হলো। রোগ ধরা পড়লোকিডনী ফেইলিউর। চট্টগ্রামের বাইরে যে মৃত্যু হলো তাদের কারণ ধরা হলো অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে বা কারো কিডনী ফেইলিউরের কারণে। চট্টগ্রামে অনুসন্ধান টিম বলছে মিসমেনেজমেন্ট ও অব্যবস্থা এটার জন্য দায়ী। আজ থেকে চার বৎসর আগে এই চট্টগ্রামে ৪/৫ জন প্রসূতি সিজারিয়ান অপারেশনের পর পরই মারা যায়। তার কারণ বলেছিল সম্ভবত স্পাইনেল অ্যানাসথেটিক ইনজেকশনের কারণে কিডনী ফেইলিউর হয়। ইনজেকশন বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কোনও অনুসন্ধান হয়নি ও গবেষণা হয়নি। হলে ভালো হতো। আসল কারণটা জানা যেতো এবং এখন পুনরাবৃত্তি হতো না। ঝিনাইদহে গত একমাস এই অপারেশনে পর পর পাঁচ প্রসূতির মৃত্যু হয়। সেখানকার সিভিল সার্জন বলেছেন মৃত্যুর কারণ লিভার এবং কিডনী ফেইলিউর। প্রশ্ন হলো যদি ভেজাল ওষুধের কারণে মৃত্যু ঘটে থাকে তবে একই ইনজেকশান অন্য শত শত অপারেশন রোগীদের শরীরে ব্যবহার হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে কোনও অভিযোগ আসছে না। গভীর গবেষণা দরকার। কারণ অবশ্যই থাকবে। খবরে প্রকাশ হাজার হাজার জাল সনদ নিয়ে নার্সেরা বেসরকারি চিকিৎসালয়ে কাজ করছে। তারা হয়ত অনভিজ্ঞ তাদের অনাভিজ্ঞতার কারণে রোগীর ক্ষতি হতে পারে।

একজন অসুস্থরোগীর যন্ত্রণা যে কতঅপরজন সেটা বুঝবে না। এরা সুস্থ হয়ে উঠে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে। সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। পৃথিবীর আলো দেখতে পায়। সুতরাং ওষুধ নিয়ে যারা কারসাজি করে তারা যেন মানবিক হয় এবং তাদের সুবুদ্ধির উদয় হোক।

লেখক: প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশে রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপত্রলেখক এম এ গফুর :
পরবর্তী নিবন্ধপাশ্চাত্য ‘উদারবাদের’ মহিমা ও আমাদের আত্মানুসন্ধান