অসুস্থ হলে মানুষ চিকিৎসকের কাছে যান। চিকিৎসক ওষুধ লিখেন। এখন সেই ওষুধ যদি ভেজাল কিংবা অনুমোদনহীন হয়, তবে সেটি হয়ে উঠতে পারে নতুন রোগের কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুমোদনহীন কিংবা ভেজাল ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। একবার ভেবে দেখুন, সুস্থ হওয়ার আশায় রোগী নিয়ম করে ওষুধ খাচ্ছেন। উল্টো ভিতরে ভিতরে নতুন নতুন রোগের উদ্ভব হচ্ছে। তবে অনুমোদনহীন ও ভেজাল ওষুধ যাদের তদারকি করার কথা, মাঠ পর্যায়ে তাদের জনবল সংকট রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার তদারকি করতে হয়। এসব উপজেলায় ১৫ হাজারের বেশি নিবন্ধিত ওষুধের দোকান আছে। এছাড়া অলিগলিতে অনিবন্ধিত ওষুধের দোকানের সংখ্যা কম নয়। এছাড়া বিভিন্ন বাসাবাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ভেজাল ও অনিবন্ধিত ওষুধ বাজারজাত করা হচ্ছে।
ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতে, এসব ওষুধ বাজারজাতকরণে সহায়তা করছেন খোদ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। বিভিন্ন অসাধু ওষুধ কারখানার মালিকদের সাথে যোগসাজস করে চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে এসব ওষুধ লিখছেন চিকিৎসকরা। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও আছেন।
ঔষধ প্রশাসনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মকর্তারা জানান, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে বর্তমানে দুজন ড্রাগ সুপার এবং একজন সহকারী পরিচালক দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। জনবলের কারণে মাঠ পর্যায়ে তদারকিতে বিঘ্ন ঘটছে। ফলে উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন ওষুধ বিপণন কমকর্তা ও স্থানীয় সোর্সকে বাধ্য হয়ে কাজে লাগাতে হচ্ছে। আমরা বিভিন্ন উপজেলার ফার্মেসিতে পরিদর্শনে যাই, গিয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছি। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে চিকিৎসকদেরকে। কারণ চিকিৎসকরা অনুমোদনহীন ওষুধ লিখছেন, তাই রোগীরা কিনছেন। অনুমোদনহীন ওষুধ বেশিরভাগ রোগীর না চেনার কথা। তবে আমাদের কথা হচ্ছে, ড্রাগ অ্যাপ্রুভড রেজিস্ট্রেশন (ডিএআর) নম্বর এবং মেডিকেল অথরাইজেশন (এমএ) নম্বর ছাড়া কেউ যেন ওষুধ না কেনে। কারণ বিদেশি কিংবা অনুমোদনহীন ওষুধের গায়ে ডিএআর ও এমএম নম্বর থাকে না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডে কথা হয় আবদুস সাত্তার নামে এক রোগীর সঙ্গে। অনুমোদনহীন ও ভেজাল ওষুধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডাক্তার যে ওষুধ লিখেন আমি সেটি কিনি। এখন ওষুধ কোনটি ভেজাল কোনটি ঠিক, সেটি তো আমরা বলতে পারব না। এসব দেখা দায়িত্ব সরকারের।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য আজাদীকে বলেন, আমরা সবসময় নকল ও ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে। এখন কেউ যদি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরি কিংবা বাজারজাত করে, তাহলে সেটি আমাদের পক্ষে নজরদারি করা কঠিন। হাজারী গলিতে যতবার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়েছে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমরা সহযোগিতা করেছি। হাজারী গলিতে লাগেজে অনেক বিদেশি ওষুধ আসে। তবে আমার কথা হচ্ছে, এসব ওষুধ হয় বিমানবন্দর, নয়তো স্থলবন্দর দিয়ে আসছে। এসব ওষুধ আসার সময় ধরলে আর বাজারে প্রবেশ করতে পারে না।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এসএম সুলতানুল আরেফিন আজাদীকে বলেন, ভেজাল কিংবা অনুমোদনহীন ওষুধের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। তবে এক্ষেত্রে কিছু কিছু চিকিৎসক এসব ওষুধ তাদের ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এখন বাজারে যদি কোনো একটি ওষুধের চাহিদা না থাকে, তখন তো সেটি আর কেউ কিনবে না। এছাড়া বিদেশি অনুমোদনহীন ত্বকের ক্রিম, তেল, ভিটামিন ও মিনারেল জাতীয় ওষুধ অনেক চিকিৎসক তাদের ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন।
তিনি বলেন, কিছুদিন আগে আমরা হাজারী গলিতে দেখেছি, সঠিক তাপমাত্রায় ইনসুলিন সংরক্ষণ না করে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া জার্মানি, ভারত, থাইল্যান্ড ও হংকংয়ের অনুমোদনহীন ওষুধের মজুদ দেখা গেছে এসব দোকানে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যারা ভেজাল কিংবা অনুমোদনহীন ওষুধ বাজারজাত করে মাঠ পর্যায়ে তাদের অনেক এজেন্ট আছে। তারা বিভিন্ন চিকিৎসককে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে তাদের ওষুধ লেখার জন্য প্ররোচিত করে। এছাড়া বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও অনুমোদনহীন বিভিন্ন ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম ও ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম কার্যালয়ে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের অন্তত ১০ জন ড্রাগ সুপার প্রয়োজন। এছাড়া উপ–পরিচালকের পদ থাকলেও ওই পদে দীর্ঘদিন ধরে কেউ নেই। শুধুমাত্র দুজন ড্রাগ সুপার দিয়ে পুরো চট্টগ্রাম জেলার কার্যক্রম তদারকি করা কষ্টসাধ্য।
উল্লেখ্য, ২০ মার্চ নগরের মেহেদীবাগ এলাকার শহীদ মির্জা লেইনে নুর ভিলা নামে একটি আবাসিক ভবনে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অনুমোদনহীন ওষুধ ও প্রসাধনী জব্দ করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। জানা গেছে, ভবনটিতে ভার্চুয়াল হেলথ কেয়ার নামে ঢাকার একটি ওষুধ কারখানার কার্যালয় ও গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। অভিযানে স্নায়ুবিক দুর্বলতা, যৌন সমস্যা, সৌন্দর্যবর্ধন, বন্ধ্যাত্ব সমস্যার ওষুধ ও প্রসাধনী পাওয়া যায়। তবে এসব ওষুধের অনুমোদন ছিল না। এর আগে ১৬ মার্চ হাজারী গলিতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নষ্ট ইনসুলিন ও টিটেনাস ভ্যাকসিন জব্দ করা হয়।