কদিন আগেও এক পাতা নাপা (প্যারাসিটামল- ৫০০ মি. গ্রা.) ট্যাবলেট ৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে ফার্মেসিতে। তবে এখন ওই এক পাতা নাপা মানুষকে কিনতে হচ্ছে ১২ টাকায়। এক পাতা এ্যসপিরিন (৩০০ মি. গ্রা.) ১৫ টাকার স্থলে ২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অ্যামোঙিসিলিন (বিপি ৫০০ এমজি) ইনজেকশনের দাম ছিল ২৫ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫৫ টাকা। শুধু এই কয়টি নয়, চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি অত্যাবশ্যক ওষুধের দাম বেড়ে গেছে হঠাৎ করে। এমনিতে নিত্য পণ্যের বাড়তি দামে কাহিল সাধারণ মানুষ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানিসহ বিভিন্ন সেবা খাতেও সংকটের শঙ্কা জেগেছে। এর মাঝে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে। দাম বাড়লেও অতি জরুরি এবং অত্যাবশ্যকীয় এসব ওষুধ না কিনেও উপায় নেই মানুষের। এতে করে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষই কষ্টে পড়েছেন বেশি। জীবন যাত্রায় আরেক দফা চাপ বাড়ল বলছেন সাধারণ ও নানা শ্রেণির মানুষ।
বহদ্দারহাটের হক মার্কেটের সামনে বেশ কয়টি ওষুধের দোকান (ফার্মেসি) রয়েছে। সবসময় ওষুধ কিনতে আসা মানুষের ভিড় লেগেই থাকে এসব দোকানে। রহমান মিয়াও এদের একজন। পেশায় রিকশা চালক। গতকাল বিকেলে একটি ওষুধের দোকানের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। পরিবারের একাধিক সদস্য জ্বর ও সর্দিতে আক্রান্ত। চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। পরে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে এসেছেন তিনি। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নাপা এঙটেন্ড (৬৫০ এমজি) নিতে হয়েছে তাকে। আরো কয়েকটি ওষুধও লেখা হয় প্রেসক্রিপশনে। দোকানদার এক পাতা নাপা এঙটেন্ড-এর দাম রেখেছে ২০ টাকা। অথচ কদিন আগেও এটি ১৩/১৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বাড়তি দামের কথা জেনে বড় করে কেবল একটি দীর্ঘশ্বাসই ফেললেন এই রিকশা চালক। আর কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান তিনি।
পাশে দাঁড়িয়ে ওষুধ কিনছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী সাদ্দাম হোসেন। ওষুধের বাড়তি দামের বিষয়ে তিনি বলেন, কি আর বলবো। বলেও কি হবে! সব কিছুই তো নাগালের বাইরে। চাল-ডাল, তেল সবকিছুরই দাম আকাশ ছোঁয়া। এক প্যাকেট বেলা বিস্কিটের দামও এখন আগের তুলনায় ২০ টাকা বেশি। এখন নতুন করে ওষুধটাও যোগ হল। বলতে গেলে সাধারণ মানুষের কোনোভাবে খেয়ে-পরে থাকার উপায়টাও সেভাবে থাকছে না।
ওষুধ দোকানিরা বলছেন, ওষুধ কোম্পানি এখন বাড়তি দাম রাখছে। অর্থাৎ বাড়তি দামেই ওষুধ সরবরাহ করছে। যার কারণে তাদেরও বাড়তি দামে বিক্রি না করে উপায় নেই। জামালখানের একটি ওষুধের দোকানদার বাবুল চৌধুরী বলেন, এক পাতা নাপা আগে ৮ টাকায় বিক্রি করতাম। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ১২ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। একইভাবে নাপা এঙটেন্ড বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। এটি আগে ১৪ টাকা ছিল। এরকম অনেকগুলো খুব কমন ওষুধের দাম বেড়ে গেছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় ২১৯টি ওষুধ আছে। এর মধ্যে ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এই ১১৭টির মধ্যে ৫৩টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধিদপ্তর। গত ৩০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় এসব ওষুধের পুনঃনির্ধারিত দাম অনুমোদন করা হয় বলে জানা গেছে।
ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল, এঙিপিয়েন্ট, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময়মূল্য, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা কারণে ওষুধ উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম বাড়াতে সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এর প্রেক্ষিতে অত্যাবশ্যকীয় ৫৩ ধরনের ওষুধের দাম পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে বলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে।
দাম বাড়ানোর বিষয়ে অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র আইয়ুব হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো কিছু ওষুধের দাম বাড়ানোর আবেদন করেছিল। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তর ৫৩টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছে। অধিদপ্তরের নির্ধারিত মূল্যের বাইরে কেউ ওষুধ বিক্রি করতে পারবে না।
এদিকে, অত্যাবশ্যকীয় এসব ওষুধের দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত এখন পর্যন্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে জানা যায়নি। তবে বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই বাজারে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে এসব ওষুধ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন, চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, কোম্পানিগুলো নতুন বাড়তি দামে ইনভয়েস করে ওষুধ বিক্রি করছে। মূল্য বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন বা বিজ্ঞপ্তি না হলে এটি হওয়ার কথা নয়। সে হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে বলেই আমরা মনে করছি। তবে এ বিষয়ে ঢাকার (কেন্দ্রীয়) ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর নিশ্চিত করে বলতে পারবে। ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি রয়েছে। কমিটি সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়েই ওষুধের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এক্ষেত্রেও সেটি হয়েছে বলে আমরা জেনেছি।