চট্টগ্রাম মহানগরীতে পরিকল্পিত স্যুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নের আরো দুটি ক্যাচমেন্টের ৫ হাজার কোটিরও বেশি টাকার একটি প্রকল্প গতকাল একনেকে অনুমোদন পেয়েছে। তবে এখনি প্রকল্পটির কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না। ভূমি অধিগ্রহণের দুই হাজার কোটি টাকার অপর একটি প্রকল্পের অনুমোদনের পরই স্যুয়ারেজ প্রকল্পের কালুরঘাট এবং বাকলিয়া অংশের কাজ শুরু হবে। ইতোপূর্বে শুরু হওয়া ক্যাচমেন্ট–১ এর কাজ ইতোমধ্যে ৬০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ফ্রান্সের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এএফডি’র অর্থায়নে কাট্টলী এলাকার ক্যাচমেন্ট–৫ এর ২৭শ’ কোটি টাকার অপর একটি প্রকল্প আগামী একনেকে অনুমোদন হতে পারে। সবকিছু মিলে চট্টগ্রাম মহানগরীকে ৬টি পৃথক ক্যাচমেন্টে বিভক্ত করে নেয়া পরিকল্পিত স্যুয়ারেজ প্রকল্পের কাজ ক্রমে গতি পাচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, ৭০ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস চট্টগ্রাম মহানগরীতে। বিপুল সংখ্যক মানুষের এই নগরীতে পরিকল্পিত কোনো স্যুয়ারেজ প্রকল্প ছিল না। মানুষের বাসা বাড়িতে সেপটিক ট্যাংকে ময়লা জমা হয়। এছাড়া প্রতিদিন নগরীতে প্রায় ২৮৮ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য পানি নিঃসৃত হয়ে নদীতে পড়ছে। ২০৩০ সালে এর পরিমাণ প্রতিদিন ৫১৫ মিলিয়ন লিটারে গিয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ৫৩৯ ঘনমিটার ফিক্যাল স্লাজ সেপটিক ট্যাংকে জমা হচ্ছে, যা আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন প্রায় ৭১৫ ঘনমিটার হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
ওয়াশরুমের বর্জ্য পানি নগরীর নালা হয়ে নদীতে পড়ছে। নালার ভিতর দিয়ে যাওয়া ওয়াসার পাইপ লাইনেও এসব পানি ঢুকে পড়ছে। শহরের পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে যা সার্বিকভাবে চট্টগ্রামের পরিবেশ দূষণ করছে বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে যে, ভবিষ্যতে মহানগরীতে সুপেয় পানি সরবরাহে সংকট সৃষ্টির শংকা রয়েছে। পরিকল্পিত কোনো স্যুয়ারেজ সিস্টেম গড়ে না উঠায় বছরের পর বছর ধরে টয়লেটের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মহানগরী শূন্যের কোটায় রয়েছে। যা ঘুরে ফিরে উন্মুক্ত মলমূত্র ত্যাগের মতো অবস্থা সৃষ্টি করছে।
১৯২৩ সালে ঢাকায় স্যুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও ১৯৬৩ সালে ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামে । গত ৬১ বছরেও পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য অতি প্রয়োজনীয় এই ধরনের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি। চট্টগ্রামকে হেলদি সিটিতে পরিণত করতে হলে স্যুয়ারেজ সিস্টেমের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি অনুধাবন করে পুরো নগরীকে ছয়টি জোনে বিভক্ত করে ছয়টি স্যুয়ারেজ এবং দুটি ফিকেল স্ন্যাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করার প্রকল্প গ্রহণ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। ছয়টি জোনের মধ্যে প্রথমপর্যায়ে ক্যাচমেন্ট–১ এর কাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। প্রথম পর্যায়ে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে স্যুয়ারেজ প্রকল্পের আওতায় আনার কার্যক্রম শুরু হয়। এই কার্যক্রমে নগরীর ২১টি ওয়ার্ডের ২৮ হাজার বাড়ি ঘরে স্যুয়ারেজের লাইন যুক্ত করা হচ্ছে।
২০০ কিলোমিটারেরও বেশি পাইপ লাইন স্থাপন করা হচ্ছে মাটির ৫ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত গভীরে। নির্মাণ করা হচ্ছে প্রয়োজনীয় ম্যানহোলসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো। এরমধ্যে একটি অংশে হালিশহরের চৌচালায় ১৬৩ একর ভূমিতে দুইটি সর্বাধুনিক ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করা হচ্ছে। যার একটিতে পাইপ লাইনের মাধ্যমে আনা বর্জ্য প্রতিদিন নয় কোটি লিটার পরিশোধন করে পরিবেশ সম্মতভাবে সাগরে ফেলে দেয়া হবে। অপর প্ল্যান্টটি ফেক্যাল প্লাসের ( বিশেষ ধরনের গাড়িতে বাসা বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য) মাধ্যমে সংগৃহীত দৈনিক ৩০০ টন বর্জ্য পরিশোধন করা যাবে। এই প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে ৬০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি চট্টগ্রামকে বিশ্বমানের নগরীতে পরিণত করার যাত্রা অনেকটা এগিয়ে দেবে।
ক্যাচমেন্ট–১ এর কাজের পাশাপাশি গতকাল ক্যাচমেন্ট–২ (কালুরঘাট এবং সন্নিহিত অঞ্চল) এবং ক্যাচমেন্ট–৪ (বাকলিয়া এবং সন্নিহিত অঞ্চল) এর পাঁচ হাজার ১৫২ কোটি ৫৬ লাখ টাকার একটি প্রকল্প একনেকের অনুমোদন লাভ করেছে। কালুরঘাটের হামিদচরের ৭৪ একর জায়গায় প্রকল্পের মূল স্থাপনা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হবে। এটি দৈনিক ৬০ হাজার ঘনমিটার ধারণ এবং প্রয়োজনীয় পরিশোধন করবে। প্রকল্পের অধীনে প্রধান স্যুয়ারেজ লাইন নির্মাণ করা হবে ১১ কিলোমিটার, শাখা স্যুয়ারেজ লাইন ৭০ কিলোমিটার এবং সার্ভিস লাইন হবে ৭০ কিলোমিটার। প্রকল্পের আওতায় ৯৩২টি ম্যানহোল এবং গৃহ সংযোগ ও ক্যাচপিট নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পে দুইটি এলাকার ২৮ হাজার ঘর বাড়ি সংযুক্ত করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জামালখান, চকবাজার, চান্দগাঁও, শুলকবহর ও ষোলশহরসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা উপকৃত হবেন। জাপানের জাইকা, বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম ওয়াসা যৌথভাবে প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে জাইকা দেবে ৪ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা, বাংলাদেশ সরকার ৯৬৯ কোটি টাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসা বহন করবে ৩৯ কোটি টাকা বলে সূত্র জানিয়েছে।
একনেকের অনুমোদন লাভ করলেও প্রকল্পটির কাজ এখনি শুরু করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে সূত্র বলেছে যে, এই প্রকল্পের জন্য বাকলিয়া মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীত পাশের হামিদচর এলাকায় ৭৪ একর জায়গা হুকুম দখল করতে হবে। এজন্য দুই হাজার কোটি টাকার আলাদা একটি প্রকল্প ইতোমধ্যে প্ল্যানিং কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন এবং ভূমি অধিগ্রহণের পরই মূল প্রকল্পটির কাজ শুরু হবে।
অপরদিকে ক্যাচমেন্ট–৫ (কাট্টলী এবং সন্নিহিত অঞ্চল) এর ২৭শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও প্ল্যানিং কমিশনে রয়েছে। এটিও আগামী একনেকের সভায় উত্থাপিত হতে পারে। একনেকের অনুমোদন পাওয়ার পর ক্যাচমেন্ট–৫ এর কাজও শুরু হবে। ক্যাচমেন্ট–১ এর কাজ আগামী বছরের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও অন্যান্য ক্যাচমেন্টগুলো বাস্তবায়নে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ওয়াসার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, পরিকল্পিত স্যুয়ারেজ নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবেশের পাশাপাশি শহরের ইমেজ বহুগুণে বৃদ্ধি করবে।