বাঙালির জীবনে উৎসব–পার্বণের কমতি ছিল না আগেও। অবশ্য বেশির ভাগই ছিল নানা ধর্ম সম্প্রদায়ের আবাহন থেকে। ভাগ্যাহত বাঙালি জীবনের কঠিন সংগ্রামের ফাঁকে উৎসবের আয়োজন করেছে। এরপরও ঈদ, পূজা ইত্যাদি উৎসবগুলো সর্বজনীন সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। সময়ের পালাবদলে দেশ ভাগ হয়েছে, বাঙালির একাংশকে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। ১৯৬০ এর দশকে রাষ্ট্রযন্ত্রের রবীন্দ্র বিরোধিতার প্রতিবাদী পথ ধরে নতুন করে বাঙালি শেকড়ের সন্ধানে নেমেছে। ঢাকার রমনা উদ্যানের সংগ্রাম ছোট থেকে বড় হয়েছে। ক্রমান্বয়ে পহেলা বৈশাখ ধর্মবর্ণ মিলে বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। ত
বে মানতেই হবে, পুরনো দিন বদলে যাচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো পর্যন্ত বদলেছে। প্রথম দিকে শহর–কেন্দ্রিক হলেও ক্রমান্বয়ে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের উৎসব গ্রামগঞ্জে ছড়িয়েছে ধনাঢ্যের চৌকাঠ পেরিয়ে এর আমেজ মধ্যবিত্ত, এমন কী নিম্নবিত্তের দুয়ারে পৌঁছেছে। নববর্ষের উদ্যাপন এখন বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার বড় উপলক্ষ। যে বাংলা সন মোগল আমলের কৃষি পণ্যের খাজনা আদায়ে প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা আজ পরিবর্তিত রূপে আবির্ভূত হয়েছে। অর্ধ শতাব্দিরও বেশি সময় ধরে বাঙালি নববর্ষকে কেবল নিজ সংস্কৃতির অংশই করে নেয়নি, সময়ের পরতে তা সমাজসংস্কৃতির অঙ্গ হয়েছে। সময়ের যা দাপট, তা যদি না হতো তাহলে বাংলার লোকসংস্কৃতি কিংবা বাংলা ঋতুর কথা বাঙালির নতুন প্রজন্ম ভুলেই যেত! ক্রমান্বয়ে নানা অনুসঙ্গ এসেছে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনে; যুক্ত হয়েছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ডালি, নতুন সংযোজন এসেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রায়, অশুভের বিনাশ কামনায়, সত্য ও সুন্দরের প্রার্থনায় শামিল হয়েছেন ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে সব পেশা, সব শ্রেণির মানুষ। নানা রঙের শাড়ি, মুখে আলপনা, বাহারি পাঞ্জাবি, ফুলের বিচিত্র শোভা। এ সবের সঙ্গে তরুণদের হাতে জাতীয় পতাকা দেখে আমাদের সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। তারুণ্যের এ প্রত্যয় অসাম্প্রদায়িকতা পক্ষে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে; এ যেন অন্ধকার থেকে আলোতে এগিয়ে যাওয়া। এখন বাঙালি জাতির শাশ্বত ঐতিহ্যের প্রধান অঙ্গ পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ মানেই বাংলার লোকজ–সংস্কৃতির মূল্যবান অনুষঙ্গ– গ্রামীণ মেলা, হালখাতা, আদিবাসী পল্লীতে বৈসাবি উৎসব, যাত্রাগান, পালাগান, পুতুলনাচ, অঞ্চলভিত্তিক লোকসংগীত, ঘোড়দৌড় প্রভৃতি। সত্যিকার অর্থে পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির জীবনে একটি পরম আনন্দের দিন। নতুনের বার্তা নিয়ে বেজে উঠে বৈশাখের আগমনি বার্তা। দুঃখ, জরা, ব্যর্থতা ও মলিনতাকে ভুলে সবাই জেগে ওঠে মহানন্দে। ফসলি সন হিসেবে মোঘল আমলে যে বর্ষ গণনার সূচনা হয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা আজ সমগ্র বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক স্মারক উৎসবে পরিণত হয়েছে। পহেলা বৈশাখের মাঝে বাঙালি খুঁজে পায় নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও চেতনার স্বরূপ। বৈশাখ শুধু উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আত্মবিকাশ ও বেড়ে ওঠার প্রেরণা। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মুক্তিসাধনায় পহেলা বৈশাখ এক অবিনাশী শক্তি। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও গণতান্ত্রিক বিকাশে সংস্কৃতির এই শক্তি রাজনৈতিক চেতনাকে দৃঢ় ও বেগবান করে। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতীয় সংস্কৃতির এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জাতি হিসেবে বাঙালির জন্য পরম গৌরব ও মর্যাদার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রদর্শন ও আদর্শের অন্যতম ভিত্তি ছিল দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ ও জাতীয় চেতনার উন্মেষ। সেই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ জীবনে সহবন্দীদের নিয়ে নববর্ষ উদযাপন করেছিলেন।
পহেলা বৈশাখ আমাদেরকে উদার হতে শিক্ষা দেয় এবং জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বমানবের সঙ্গে মিশে যাওয়ার শক্তি জোগায়। এই উদার নৈতিক চেতনাকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আদর্শ এবং রাষ্ট্রভাষা চেতনার বহ্নিশিখা অন্তরে ধারণ করে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত, সুখী–সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ হোক আজকের দিনে সবার অঙ্গীকার। আমাদের মনের ভিতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। এবারের পহেলা বৈশাখ বরণের আনন্দে মেতে ওঠেছে পুরো জাতি। মঙ্গল শোভাযাত্রা, হালখাতা, বৈশাখী গ্রামীণ মেলা, পান্তা–ইলিশ খাওয়া, ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের পানি খেলা, ফুলবিজু পালনসহ নানা আয়োজন ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে স্বাগত জানানো হলো বাংলা নতুন বছরকে। নতুন বছর সব অশুভ, অসুন্দরের ওপর সত্য ও সুন্দরের জয় এবং ফেলে আসা বছরের সব শোক–দুঃখ–জরা দূর করে সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।
লেখক: অধ্যাপক, রামু সরকারি কলেজ, কক্সবাজার।