কার্তিকে হালকা মেজাজের শীতল সকাল। নরম রোদের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ক্রমশ। এরই মাঝে বেজে উঠল ট্রেনের হুইসেল। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকের ট্রেনের হুইসেলটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ সারাদেশের মানুষের জন্য অনেক বেশি আনন্দের, কারণ প্রথমবারের মতো এই ট্রেনের হুইসেল বাজবে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর প্রথমবারের মতো আজ রোববার ট্রেন যাচ্ছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় ২০১৭ সালে দোহাজারী-কক্সবাজার ১০২ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ শুরু করেন।
তবে আজকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে এ ট্রেন যাত্রা কোনো ট্রায়াল রান নয়, মূলত এ রেলপথের নির্মাণ কাজ পরিদর্শন অর্থাৎ দীর্ঘ ১০২ কিলোমিটার রেলপথ, কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন বিল্ডিংসহ ৯টি স্টেশন ভাবনসহ যাবতীয় কাজে কোনো ত্রুটি আছে কি-না তা যাচাই করতে প্রথমবারের মতো পর্যবেক্ষণ দল নিয়ে যাচ্ছে ট্রেনটি।
আর কত স্পিডে ট্রেন চলতে পারবে সেটাও পর্যবেক্ষণ করবে এ টিম। প্রধানমন্ত্রী আগামী ১১ নভেম্বর এ রেলপথ উদ্বোধন করবেন, তার আগে সামগ্রিক বিষয় জানান দেয়ার জন্য এটা করা হয়।
রোববার (৫ নভেম্বর) সকাল ৯টায় আটটি বগি পর্যটন নগরী কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম স্টেশন ছাড়ে ট্রেনটি। এই ট্রেনে আছেন গভার্মেন্ট ইন্সপেক্টর অব বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিদর্শক রুহুল কাদের আজাদসহ তার টিমের সদস্যরা।
তারা এ রেলপথ ইন্সপেকশন করবে। এটা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটা বিভাগ। যেটা বাংলাদেশ রেলওয়ের বাইরে, কিন্তু রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গভার্মেন্ট ইন্সপেক্টর।
পরিদর্শন টিমের সাথে আছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চালের জিএম নাজমুল ইসলাম, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন, রেলের পূর্বঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা, অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরীসহ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের উর্ধতন কর্মকর্তারা।
এ যাত্রায় নির্মাণাধীন দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন ও বিভিন্ন স্টেশন পরিদর্শন করবেন তারা।
কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতুতে ট্রেন ইঞ্জিনের ট্রায়াল রান সফলভাবে শেষ হয়েছে। গত ৪ নভেম্বর (শনিবার) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তিনটি রেল ইঞ্জিন চালিয়ে এটি যাচাই করা হয়। কালুরঘাট সেতুর ওপর ইঞ্জিনের ট্রায়াল রান সফল হওয়ার পর আজ প্রথমবারের মতো নব নির্মিত রেলপথ দিয়ে কক্সবাজার ট্রেন যাচ্ছে।
শুরুতে সাড়ে ১০ টনের ২২০০ সিরিজের ইঞ্জিন, তারপর ১১.১৬ টনের ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিন এবং সবশেষ ১৫ টনের তিন হাজার সিরিজের ইঞ্জিন সেতুতে চলাচল করে। আর এ সিরিজের ইঞ্জিন দিয়েই কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলবে।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের ইন্সপেকশন টিম এ রেলপথ পরিদর্শন করবেন। টিমটি এ রেলপথের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়াবে এবং ধীরে ধীরে কক্সবাজারের দিকে যাবে। একই সঙ্গে নবনির্মিত রেলপথের ব্রিজগুলোতেও দাঁড়াবে।
মূলত উদ্বোধনের আগে খুঁটিনাটি সব বিষয় পর্যবেক্ষণ করবেন বাংলাদেশ রেলওয়ের ইন্সপেকশন টিম। বিকেল নাগাদ এ টিম কক্সবাজার পৌঁছাবে।
মো. সুবক্তগীন আরও বলেন, দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের কর্মকর্তা আছেন ৮ থেকে ১০ জন। আর বাকি সব বাংলাদেশ রেলওয়ের ইন্সপেকশন টিমের কর্মকর্তা।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা বলেন, শনিবার আমরা নতুন মডেলের ইঞ্জিন দিয়ে কালুরঘাট সেতুর ওপর একাধিকবার ট্রায়াল রান করেছি। কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে এখন ট্রেন চলাচলে আর কোনো বাধা নেই। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে নতুন জেলা হিসেবে যুক্ত হতে যাচ্ছে কক্সবাজার।
প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এ রেলপথ। এ পথের ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে-ঢাকা থেকে নন এসি শোভন চেয়ার ৫১৫ টাকা, এসি সিট ৯৪৮ টাকা, এসি কেবিন ১ হাজার ৩৬৩ টাকা এবং এসি বার্থ ২ হাজার ৩৬ টাকা।
পৃথক দুই ভাগে কাজটি করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইনে এছি ৩৯টি বড় সেতু, ২২৩টি ছোট সেতু ও কালভার্ট, বিভিন্ন শ্রেণির ৯৬টি লেভেল ক্রসিং। হাতি চলাচলের জন্য রয়েছে দুটি আন্ডারপাস। নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি স্টেশন। স্টেশনগুলো হলো: দোহাজারি, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১১ নভেম্বর কক্সবাজারের পথে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করবেন বলে জানানো হয়েছে। এর আগে, আজ (রোববার) ৮টি বগি ও একটি ইঞ্জিন নিয়ে দোহাজারি-কক্সবাজার নবনির্মিত এ রেলপথ যাক্রা করে একটি ইন্সপেকশন টিম।
এই ব্যাপারে কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, দোহাজারী–কক্সবাজার রেল লাইনের কাজ শেষ শেষে আজ রোববার রেলের জিআইবিআর এর পরিদর্শক চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে আটটি ট্রেনের বগি নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে।
যাত্রাপথে তারা প্রতিটি স্টেশনে দাঁড়াবেন, প্রতিটি ব্রিজে দাঁড়িয়ে সব কিছু পর্যবেক্ষন করবেন। এর আগে আমরা বেশ কয়েকবার ট্রলি চালিয়েছি। ১১ নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের তারিখ ঠিক আছে।
ইতোমধ্যে আমাদের কয়েকটি ষ্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে। দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার– এসব স্টেশনে থাকবে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম।
দোহাজারী থেকে চকরিয়া এবং চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথে ৩৯টি ব্রিজ ও আন্ডারপাসসহ ২৫১টি কালভার্ট নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।
ইতোমধ্যে ঢাকা- চট্টগ্রাম – কক্সবাজার, এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে কয়েকটি নতুন ট্রেন চালুর জন্য সময় সূচি নির্ধারন করে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয় থেকে ঢাকা রেল ভবনে পাঠানো হয়েছে।