কন্টেনার এবং জাহাজজটে অনেকটা দিশেহারা হয়ে থাকা চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন ‘আপদ’ দেখা দিয়েছে এস আলম গ্রুপের প্রতি আস্থাহীনতা । এই গ্রুপের মালিকানা আছে এমন সাতটিসহ মোট নয়টি ব্যাংকের পে অর্ডার নিচ্ছে না শিপিং এজেন্সিগুলো। এতে করে বন্দর থেকে কন্টেনার ডেলিভারি এবং জাহাজীকরণ ব্যাহত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে আসা কন্টেনার জাহাজগুলোর লোকাল এজেন্ট হিসেবে কাজ করে এমন প্রায় দেড়শ’ শিপিং এজেন্সি এস আলম গ্রুপের মালিকানা রয়েছে এমন সাত ব্যাংকের পে অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দেয়ায় আমদানি রপ্তানিকারকেরা বেকায়দায় পড়েছেন। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাহত হতে শুরু করেছে। বিষয়টি সুরাহা করতে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশন বিকল্প পন্থার খোঁজ করছে।
সূত্র জানিয়েছে, কোটা সংস্কার ইস্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। কারফিউ, সাধারণ ছুটিসহ আন্দোলন সংগ্রামে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ থাকায় বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি কার্যক্রম দিনের পর দিন বন্ধ থাকে। এতে করে বন্দরে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ কন্টেনার এবং জাহাজজট। জাহাজের গড় অবস্থানকালও বেড়ে গেছে।
গতকালও চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ১৬টি কন্টেনার জাহাজ অলস বসেছিল। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহ ধরে বসে আছে এমন জাহাজও রয়েছে। অপরদিকে বন্দরের ইয়ার্ডে স্বাভাবিক সময়ে গড়ে ৩০/৩১ হাজার টিইইউএস কন্টেনার থাকলেও পরিস্থিতির কারণে তা ৪৪ হাজারে গিয়ে ঠেকে। অবশ্য গতকাল তা ৩৯ হাজার ৯৮০ টিইইউএস ছিল। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় ১০ হাজার টিইইউএস বেশি কন্টেনার থাকায় বন্দরের অপারেশনাল কর্মকান্ড ব্যাহত হচ্ছে।
কন্টেনার এবং জাহাজজট সামলাতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নানা অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি ও বাস্তবায়ন করছে। বন্দরের সচিব ইতোপূর্বে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে এস আলম গ্রুপের মালিকানা রয়েছে এমন সাতটিসহ মোট নয়টি ব্যাংকের পে অর্ডার নিয়ে। কন্টেনার জাহাজীকরণ এবং ডেলিভারি নেয়ার আগে আমদানি এবং রপ্তানিকারকদেরকে শিপিং এজেন্সিগুলোর পাওনা পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে জাহাজের ভাড়া, কন্টেনারের ভাড়া, ডেমারেজসহ নানা ধরণের পাওনা থাকে। পাওনাগুলো পরিশোধ করার পরই সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক কিংবা রপ্তানিকারককে শিপিং এজেন্সি থেকে ডিও দেয়া হয়। ওই ডিও’ নিয়ে পরবর্তী ধাপগুলো পার হয়ে পণ্য জাহাজীকরণ কিংবা ডেলিভারি দেয়া হয়ে থাকে।
এস আলম গ্রুপের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া, এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থান গত কয়েকদিন ধরে পত্রপত্রিকায় প্রচার হচ্ছিল। এই অবস্থায় এস আলম গ্রুপের মালিকানায় থাকা ব্যাংকগুলো চরমভাবে আস্থার সংকটে পড়ে। এসব ব্যাংক থেকে ইস্যুকৃত পে অর্ডার নগদায়ন হবে কিনা সেই সন্দেহ প্রকট হয়ে উঠায় শিপিং এজেন্সিগুলো তা আর নিচ্ছে না। ফলে আমদানি রপ্তানিকারকেরা শিপিং এজেন্সির পাওনা পরিশোধ করতে না পারায় কন্টেনার জাহাজীকরণ এবং ডেলিভারি নিতে পারছেন না। যা বন্দরের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
একাধিক শিপিং এজেন্সির অফিসে ৯ ব্যাংকের নাম উল্লেখ করে এসব ব্যাংকের পে অর্ডার গ্রহণ করা হবে না বলে নোটিশ টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।
বিষয়টি নিয়ে আমদানিকারকেরা গতকাল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, পে অর্ডার মানে নগদ টাকা। কোন ব্যাংক নগদ টাকা জমা নিয়েই পে–অর্ডার ইস্যু করে। ওই পে অর্ডার নগদায়ন না করার কোন সুযোগ থাকে না। শিপিং এজেন্সিগুলো ৯টি ব্যাংকের ইস্যুকৃত পে অর্ডার না নেয়ায় বহু আমদানিকারক পণ্য রপ্তানি কিংবা বন্দর থেকে খালাস করতে পারছেন না। তিনি বলেন, বহু ব্যাবসায়ীরই একটি বা দুইটি ব্যাংক একাউন্ট থাকে। এখন যাদের এসব ব্যাংকে একাউন্ট আছে তারা কি করবেন? অন্য ব্যাংকে গিয়ে পে অর্ডার করতে হলে নগদ টাকার প্রয়োজন। কিন্তু নগদ টাকা উত্তোলনে বাংলাদেশ ব্যাংক তিন লাখ টাকার সীমা নির্ধারণ করে দেয়ায় তাও ইচ্ছে করলে বাড়তি নগদ টাকাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থায় ব্যবসায়ীরা সংকটে পড়েছেন বলেও তারা উল্লেখ করেন।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পণ্য খালাস করতে আসা আমদানিকারক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। এভাবে আস্থার সংকট তৈরি হলে ব্যবসা বাণিজ্য করাতো কঠিন হয়ে যাবে। আমার একাউন্ট ইসলামী ব্যাংকে। অন্য কোন ব্যাংকে একাউন্ট নেই। এখন ইসলামী ব্যাংকের পে অর্ডার শিপিং এজেন্সি নিচ্ছে না। আমি অসহায় হয়ে চট্টগ্রামে আটকা পড়ে রয়েছি।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, এটি আসলে আস্থার সংকট। পে অর্ডারের মাধ্যমে আমদানি রপ্তানিকারকেরা যে সব পাওনা পরিশোধ করেন তা মূলত প্রিন্সিপ্যালের টাকা। শিপিং এজেন্সিগুলো খুব সামান্যই কমিশন পেয়ে থাকে। এখন যদি এসব পে অর্ডার নগদায়ন না হয় তাহলে তার পুরো টাকাই এজেন্সিগুলোকে প্রিন্সিপ্যালকে পরিশোধ করতে হবে। এত বড় রিস্ক তো শিপিং এজেন্সি নিতে পারে না। তাই শিপিং এজেন্সিগুলো উক্ত নয়টি ব্যাংকের পে অর্ডার নিচ্ছে না বলেও তিনি স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা মিটিং করেছি। আলাপ আলোচনা করেছি। আমরা বিকল্প কি করা যায় সেটি চিন্তা করছি। এক্ষেত্রে পে–অর্ডার নগদায়ন হওয়ার পর ডিও দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেটা আমরা ভাবছি। তিনি বলেন, আমদানি রপ্তানিকারকেরা একদিন আগে পে অর্ডার দিয়ে যাবেন। সেটি ব্যাংকে পাঠানো হবে। ব্যাংক যদি নগদায়ন করে শিপিং এজেন্সির একাউন্টে টাকা দেয় সেটি নিশ্চিত হওয়ার পর ডিও ইস্যু করা হবে। এক্ষেত্রে একদিন বাড়তি সময় লাগতে পারে বলেও তিনি স্বীকার করেন।